রুমালচুরি- ১



  

       কবির নাম, বয়স, লিঙ্গ, ঠিকানা ইত্যাদি যা কিছু কবিতার জন্য জরুরি নয়, তা আমরা মুছে দিয়েছি। আর এভাবেই ১০টি কবিতা পাঠানো হয়েছে অন্য এক কবির কাছে- আলোচনার জন্য। শুধু ১০টি কবিতা, আগে পরে নাথিং। আমাদের সাথে রুমালচুরির এই খেলা খেললেন ১৯ জন কবি।


       এখানেও কবির নাম ছাড়া ১০টি কবিতা রাখা হল, সঙ্গে থাকলো আলোচনা। কবির নাম জানার রাস্তা কবিতার নীচ দিয়ে গেছে। তবে আমরা বলবো রুমালচুরির এই খেলায় আপনিও থাকুন। কবির নামটা না হয় একটু পরেই জানলেন।




  ১০টি কবিতা


   আপনার আজকের দিনটি


   গিল্টির সেই ওস্তাদ কারিগর হেনরি
                          আর আমাদের মধ্যে নেই।
   আফিমের ডেরা মোমবাতির দোকান
           আর শুকনো মাছের অভিজ্ঞতা ও উত্তেজনার পর
  এখন সে মেয়েদের সেই স্তম্ভগুলোর মধ্যেই ঘুরে বেড়ায়
          যেখানে মর্নিং গ্লোরির দম আটকানো গন্ধ
  আর দূরে স্মৃতি আর মাছির সংস্পর্শ এড়িয়ে
                          শুধু আজকের মত সূর্য উঠছে।

  হাশ ইউ বেবি

  ইস্তানবুলে হেনরি কখনো যায়নি
  কিন্তু তার হেঁটে-না-যাওয়া রাস্তার নতুন একটা নাম হয়েছে
                  তার হেঁটে যাওয়াকে মনে রেখে

  একজন লিভার বিক্রেতা আর একজন মৃত্যুদন্ডের বিচারক
                  আজ সেই রাস্তায় হাঁটবে

  রাস্তা চিৎকার করত, প্রতিবাদ করত প্রকাশ্যে
  যদি না তাকে আমি আড়ালে এনে চুপ করিয়ে দিতাম
  
  তলোয়ার আর নতুন জামার গল্প

  প্রত্যাশা মতো নাই-বা ঘটুক কিছু, শুধু রং পেনসিল ঘষেই
                 উজ্জ্বল করে তোলা যাবে দেবদূতদের
  ঝকঝকে আলোয় চারটে বেড়ালের বাচ্চা জন্ম নেবে
                                        দৌড়ে আসবে
  ঝকঝকে আলোয় সব চরিত্রই দৌড়ে আসবে
                        মৃত্যুর আগে দোষ স্বীকার করবে

  প্রতিটি তলোয়ারের গল্পে নতুন জামা সমেত
                        আমি তোমাকেই বসিয়ে রাখব ক্রিস্টোফার

  আরেক রাত্রির বাড়ি

  অস্তিত্বের অর্ধেক এই শরীর শূন্যে দুলবে, আমাকে ছেড়ে বেরিয়ে যাবে
  অন্ধকারে এই রক্তক্ষরন তখন কালো মনে হতেও পারে তোমার
  ভাত আর নোনা মাছ নিয়ে রাত্রি তখন আরেক রাত্রির বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে
  চুপচাপ অপেক্ষা করছে মেয়েরা, হাসি থামানো যায়নি যাদের

  কফির দাম মেটানোর আগে

  কিছু কিছু বরফ হারিয়ে যায়। বরফের কুকুর তবু বসে থাকে তোমার জন্য। কখন ফিরবে...
  শুধু জন্মদিনেই যারা জন্মায় বেঁচে থাকে, তাদের চেনা কঠিন, ক্রিস্টোফার।
  আর তাদের চেনাও কঠিন
  চওড়া নৌকার মাঝখানে লাল আলোর মতো বসে থাকে যারা
  আর কফির দাম মেটানোর আগে বিড়বিড় করে ক্ষমা চেয়ে নেয়।

  বরফের কুকুর হাঁপাচ্ছে
  শুকনো জিভের মতো কফির কাপ এগিয়ে আসছে দাম মেটানোর জন্য।

  কখন ফিরবে...

  যে বাড়িতে দরজা নেই

  দরজা নেই।  তবু ধাক্কা না দিয়ে তুমি কিছুতেই ঢুকতে পারো না।
  প্রথমে আঙুল তুলে দরজা আঁকো। তারপর নিচু মুখে অনুমতি চাও।
  দ্যাখো, বাতাস কীভাবে জমে দরজা হয়ে ওঠে।
  বাতাস কীভাবে জমে দরজা হয়ে ওঠে।

  ধাক্কার দরকার নেইএবার হালকা টোকা। যাও, ঢুকে পড়ো।

  ফ্ল্যাটবাড়ি দুপুর দেড়টা

  গলার ওপর হাত চেপে বসছে আর আস্তে আস্তে সময় হয়ে যাচ্ছে কেউ।
  চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে আঙুল বেঁকে যাচ্ছে বিভৎসভাবে, আর
                        একটু দ্রুত এবার সময় হয়ে উঠছে কেউ।

  হাতলে রক্তের দাগ নিয়ে
  একটা দরজার নিঃশব্দে বন্ধ হওয়ার সময়ের সাথে
  দ্রুত নেমে যাওয়া পায়ের শব্দের সময় মিলিয়ে নিয়ে
  দৈত্যের মতো জাহাজের মতো একটা হাতঘড়ি
  সময় অথবা বুদবুদ অথবা চিউয়িংগাম হয়ে যাচ্ছে

  জিভ ও জাগুয়ার

  হেঁটে গিয়েছিলে ভারী অস্তিত্ব নিয়ে কালো জাগুয়ারের পা নিয়ে
  জিভ জড়িয়ে যাবে যদি বলি তোমাকে দেখিনি, আগে চিনতাম না কখনো
  আগে শাস্তি পায় তারপরই চিরদিন কেমন ভাল হয়ে ওঠে মানুষেরা
  জিভ খসে যাবে যদি বলি এই আঘাতের জন্য আমি অপেক্ষা করিনি কখনো

  নেকড়ে যেখানে হাঁটে

  ব্রিজ থেকে নামার সময়ই দেখা পেয়েছি
          তবু চিৎকার করেছিলাম কেন, জানি না ক্রিস্টোফার

  বাদামি ছায়া খুলে নেকড়ে পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল বলে?

  আলো জ্বালানোর শব্দ ছেড়ে যায়নি
          তবু চিৎকার থামাতে পারিনি কেন, জানি না ক্রিস্টোফার

  সাদা ছায়ার যাজক পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল বলে?

  কৃষ্ণগহ্বর

  এবং আবার সেই ছায়া যেখানে কোনো ছায়া নেই আলোও নেই

  মানুষ আর বস্তুর মাঝখানে যে খেলে, প্রজাপতি ধরে বেড়ায়
  যখন ধীরগতির মালগাড়ি ফুরিয়ে যেতে যেতেই ফুরিয়ে যাচ্ছে

  এবং আমার সেই অসুস্থ তামাক বিক্রেতা
  যে হাসে হাত বাড়ায় আর ছায়ার মধ্যে হারিয়ে যায়

  পার্সেল আসবে বলে যে তৈরী থাকে

  কিন্তু পার্সেল ভ্যানের জন্য অপেক্ষা করেনা কখনো




   আশ্রয় অথবা অন্ধকার যাত্রা
আলোচনা করলেন রমিত দে  


       নার্সিসাসকে আমরা অনেকেই জানি, কিন্তু নার্সিসাসের ইকোকে হয়ত সেভাবে কেউ মনে রাখিনিএকথা বলার পর নীরবতা থেকে প্রশ্ন উঠে আসতেই পারে,-‘সত্যি কি তাই’?রোমান কবি ওভিদই বোধহয় সবচেয়ে প্রথম নার্সিসাসের আরাধ্য ছবিটা,একরৈখিক ফর্মটা ভেঙে ইকোর সাথে জুড়ে দিলেন চমৎকার এক গল্প, যে গল্পে প্রাপ্তি নেই পরাজয় আছে, যে গল্পে কেউ হাসে কেউ হাততালি দেয় কেউ জীবনে ফিরে আসে কেউ হারায় কিন্তু পুরো গল্পের প্রায় সবটাই গন্তব্যহীনএবং পুরো গল্পটাকেই আবার লেখা যায়,তাকে অতিক্রম করতে না পারার যন্ত্রনাটুকুকে রোমন্থন করা যায় এবং যথারীতি গল্পটাকে আবার অতিক্রম করাও যায় না

       কিন্তু কবিতা আলোচনা করতে বসে নার্সিসাস-ইকো উপাখ্যান কেন? আসলে হাতে খান দশেক কবিতা দিয়ে বলে দেওয়া হয়েছেখোঁজো কিন্তু ,কি খুঁজব? যিনি লিখেছেন তিনি তো খুঁজে পাননি বলেই লিখেছেন, কিংবা শব্দের ভেতর সেই যে ঢুকেছেন শব্দকে সমর্থন করে , সেই থেকে সে শব্দের আঘাত নিয়ে আর তো বেরোতে পারেনি পারবেও না। ঠিক যেন ইকো কিংবা নার্সিসাসের মতই একটি চূড়ান্ত নিঁখুত ফেটে পড়ার অপেক্ষায় অপেক্ষা করছেন তিনি। এ অপেক্ষা মিথ্যে, অন্তহীন, অসহায়- অথচ এ অপেক্ষাকে প্রত্যাখানও করতে পারবেন না তিনি। কবির এই অপেক্ষা, শরীর আর আত্মার মাঝে এই থেমে যাওয়াটাকেই কবিতা বলে কি? জানি না! তবে এটা ঠিক কোথাও একটা নৈরাশ্যের অন্তিম স্বীকৃতির নির্বাচন হয়ে ওঠে সে। অথচ এই নৈরাশ্য থেকে কবির মুক্তি নেই; আবার এই না পাওয়ার মধ্যেই কিন্তু মুক্তি-অন্য এক মুক্তি, পূর্নতার অধীনতা থেকে কবিতাকে যা মুক্তি দেয়। ফলে এই হাহাকার, জীবন থেকে বেরোবার একটা দরজা বের করতে না পারার মত এক মারাত্মক অভাব স্রেফ একধরনের অনুপস্থিতি নয়, বরং একধরনের অভিঘাত যা থেকে কবি নিজেই নিজের অজ্ঞাতসারে নিত্য গড়ে উঠছে আবার জ্ঞাতসারে বেরোতে চেয়েও ত্রাসাচ্ছন্ন মানুষের মত তাঁর নিজেরই ছায়া অতিক্রম করতে পারছেন না, মেনে নিচ্ছেন সারাজীবন ক্ষইয়ে দিয়েও প্রতিচ্ছবি আর প্রতিধ্বনির এ জগত থেকে মুক্তি পাওয়া আদ্যন্ত নিষ্ফল শ্রম। সারাজীবন ধরে আত্মজিজ্ঞাসার এ রাস্তায় যেন তিনি ঘুরে বেড়ান উদ্দেশ্যহীন। একদিকে তিনি নিরুপায় অন্যদিকে নিজেই নিজের গলা টিপে ধরেছেন হত্যাকারীর মত।

       চূড়ান্ত ব্যর্থতা আর যাতনায় নিমজ্জিত এই দীর্ঘ আত্মজিজ্ঞাসার পথই কি তবে কবিতা? হয়ত এতটুকুও জানা যাবে না, তবু না জানার বিরহবোধটুকু পেতে হলে আমাদের পড়ে নিতে হবে ‘ফ্ল্যাটবাড়ি দুপুর দেড়টা’ কবিতাটা। কি আছে কবিতাটায়? কিচ্ছু নেই, সময় ছাড়া। রেঁনে ম্যাগরিটের আঁকা “ দ্য ট্রেচারি অফ ইমেজেস’ ছবিটার কথা মনে করুন, যেখানে সাদা ক্যানভাস জুড়ে কেবল কালো একটা স্মোকিং পাইপের ছবি আঁকা আর তার নিচে কালো কালো অক্ষরে লেখা এটা কোনো পাইপ নয়। এই যে যেকোনো দৃশ্যের মধ্যেই পূর্বশর্তের মত দেখার একধরনের চিহ্নিত ধারনা বা অপ্রেসিভ রিপ্রেজেন্টেশন থাকে তাকেই মানতে চাননি ম্যাগরিট। বারবার তাঁর আঁকায় দৃশ্যকে আক্রমণ করেছেন ডেপিকশন অফ ভিশনের প্রেক্ষিতে অর্থাৎ যা দেখছি তা কোথাও নেই, বরং তা দেখাকেই আরও সন্দেহের চোখে দেখতে বাধ্য করছে, বাড়িয়ে দিচ্ছে বাস্তব নামের একটি মূল সংকটকে যা একজন প্রেততাড়িত শিল্পীর কাছে সংশয়ের মূল কারণ। এবার আসি কবিতাটিতে; যেখানে একটি দরজা একটি পায়ের শব্দ একটি হাতঘড়ি কিংবা কারো গলার ওপর চেপে বসা কারও হাতের নিচে যদি লিখে দেওয়া যায় এরা এর কোনটাই নয় তাহলেও হয়ত কবিতাটার পরিবর্তন হত না কারণ মানুষের স্বপ্ন ,অন্তর্জীবন আর অসহায়তার মাঝে যে পুনরাবৃত্তির গল্প সেখানে আততায়ীর মত দাঁড়িয়ে আছে স্রেফ একটা সময়। স্বপ্নহীন,অনুভূতিহীন,শ্বাসরোধী- একটা সময় এবং কবির কাছে কেবল সেই ব্যবহার্য, তার কাছেই তিনি পরাজিত এবং শেষমেশ তাকেই তিনি প্রশ্ন করতে চান , যেন এই সময়ের সামনে দাঁড়িয়ে সমস্ত ইমেজকে গলা টিপে প্রতিশোধ নিতে চান তিনি। ভালভাবে জানেন কেউ নন তিনি, হয়ত কারু স্বপ্ন তিনি যা কোনোদিনই দেখা হবেনা, হয়ত নাম গন্তব্যহীন একটি শহরের কোনো গলি তিনি যেখানে প্রতীক্ষা করে কাটিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। অথচ রক্তমাংসের মানুষের মত বিচিত্র সব ইশারায় ভরে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। আপাতত কবির নাম-ধরা যাক সময়। যার দূরতম কোণ অবধিও হয়ত কবি কোনোদিনও পৌঁছতে পারেননা অথচ তিনি মনেপ্রাণে চান মানুষের নিয়ন্ত্রনের অতীত এক ঘটনাচক্রের বিবরণ লিখতে,অথচ তিনি পারেননা, এই মানবিক সীমাবদ্ধতাই তাঁর কাছে হয়ে উঠেছে বাকপ্রতিমা, এই অনিশ্চয়তাই হয়ত তাঁর কাছে অন্বেষনের বিষয় এবং শেষমেশ এটাই একমাত্র আয়রনি যা কিছু ঘটনাকে ঘটনাহীন করে তোলে। কবিতাটা পড়তে পড়তে ফার্ণান্দো পেশোয়ার কিছু কথা মনে পড়ে যায় যেখানে অস্তিত্ব নিয়ে কথা অথচ অস্তিত্বের চিহ্ন অবধি নেই-“ And amid all this confusion I, what’s truly I, am the centre that exists only in the geometry of the abyss: I’m the nothing around which everything spins, existing only so that it can spin, being a centre only because every circle has one. I, what’s truly I, am a well without walls but with the walls’ viscosity, the centre of everything with nothing around it.”... জানিনা, শূন্যতার এমন একগুঁয়ে ধৃষ্টতার সাথে কবির নিজের চরিত্রেরও কোথাও মিল আছে কিনা কিন্তু একটা কবিতায় প্রাণকে এভাবে প্লাজমা স্টেট এ নিয়ে আসতে গেলে অবশ্যই কবিকে দাঁড়াতে হবে নৈঃশব্দের সেই বিশাল মরুভূমিতে যেখানে শব্দের ছায়াটুকুও পড়ে না। পুরো কবিতায় একটি খুনের দৃশ্য থেকে একে একে রক্ত ,দরজা, দরজা ভেজানোর মত জ্যান্ত শব্দ কিংবা ঘড়ির পরাবাস্তবিক আস্ফালন থেকে হয়ত কোনোদিনই বোঝা যাবেনা কেন একজন কবি সময়ের সামনে এসে এমন অসহায় হয়ে পড়েন, যেমন কোনোদিনই বোঝা যাবেনা কেন তিনি বাস্তবতা আর যুক্তির অঞ্চল পেরিয়ে সব রহস্যের উত্তর জানতে দাঁড়িয়ে পড়েন সময় নামের একটি অস্পষ্ট অবস্থানের সামনে; কবিতার একেবারে শেষে এসে অদ্ভুত এই বৈপরীত্যের সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন কবি। যে সময়কে কিছু আগেই ‘দৈত্যের মত’ ‘জাহাজের মত’ বিশাল এক হাতঘড়ি ধরে ছিল তাই হয়ে উঠছে ‘বুদবুদের মত’ বা ‘চুইংগামের মত’ একটি সামান্য। বাস্তব আসলে কি!- কতকগুলো বিশেষ ধরনের শব্দ আর যন্ত্রের বাজনা ছাড়া তো কিছু নয়- যার মনের ভেতর সময়ের ভয়ের সঞ্চার করে রাখা হয়েছে। কবি সেই সময়কেই করে দিলেন সামান্য, কারণ তিনি চিনে ফেলেছেন অস্তিত্বের অশুভ ছায়াটিকে যা তাকে মিথ্যে মাংসের মালিক করে রেখেছে। সময়ের এই প্রতারিত সত্য একজন কবির কল্পনা নয় বরং একজন দ্রষ্টার প্রতিবেদন। যিনি সময়ের মার্ল্টিভার্সের মধ্যে দিয়ে আমাদের নিয়ে চলেন অস্তিত্ব আর ইগোর মধ্যবর্তী অন্তঃসারশূন্যতাকে আরও প্রকট করে দেখাবার জন্য। তিনি যে নিজেই সময়ের কাছে পরাজিত। এবং আশ্চর্যভাবে এই পরাজয়টাই বোধহয় তাঁর এক এবং একমাত্র অস্তিত্ব ,সারাজীবন ধরে একজন প্রকৃত কবির কাছে সময়কে সনাক্ত করাটাই বোধহয় একমাত্র চিনতে চাওয়া অথচ সেই চেনা যাকে দেখা যাবেনা ,ছোঁয়া যাবেনা কোনোদিনই

       সময় যেন নিজের চামড়ার চেয়েও সত্য। সৃষ্টির রহস্যে একমাত্র সেই আছে, সেই বেঁচে আছে। বিশুদ্ধ কবিও চেনেন এই সময়কে, যেভাবে চেনেন সিঁড়ির পরে ঢালু রাস্তা, বদ্ধ বাতাস আর জীবনের পাতালরাজ্যে বারবার পা ভাঙার সুদীর্ঘ যন্ত্রনা। আলো না থাকলেও তবু তিনি বিশ্বাস করতে চান পথটা হয়ত শেষ হবে কোনো এক ধাপ সিঁড়ির মাথায়। এই যে একজন পাঠককে নিয়ে শব্দের ওপর পা দিয়ে দিয়ে বেড়াতে বেরোন কবি তিনি কিন্তু জানেন পাশে তার একজন একক মানুষ, ভয় ভালবাসা কিংবা করুনার মানুষ, এবং সে চাইছে শব্দকে ধরে ধরে শূন্য অতিক্রম করতে। মুশকিলটা তখনই যখন একজন কবি বুঝে ফেলেন এ শূন্যতার কোনো শ্রেনীচরিত্র নেই, এ শূন্যতাকে সময়ের মত বিশ্বাস করা যায়না তখনই তাঁর মনে হতে থাকে তবে কি আজ পাশে অন্ধ লোকটির হাত ধরে বাড়ি পৌঁছতে যাচ্ছেন ! যিনি জানেনও না তার ফেরা ঠিক আর কতদূর ! আসলে পাঠকটি হয়ত বা কবির নিজেরই ছায়া, যে কিনা নিজেই নিজের খেলাটা বুঝে নিতে, একটা কিছুর শেষ চাইতে নিষ্পত্তি চাইতে পরিধিবিদ্ধ ছায়ার দিকে তাকিয়ে। কবিতাগুলি পড়তে পড়তে বারবার মনে হয়েছে লেখাগুলির কাছাকাছি হাজার মানুষ জড়ো হয়ে বসে রয়েছে মূল্যবান উত্তারাধিকারীর রূপে, জড়ো হয়ে বসে রয়েছে দীর্ঘশ্বাসের মত – না, কোনো সাবধানী চাপা শব্দ শুনতে নয় বরং সত্যের মত করে পুরোনো এক মিথ্যেকে শুনতে চায় তারা। নতুন এক নার্ভাসনেসকে আরও বেশি নগ্ন করে দিয়েছেন কবি। “জিভ ও জাগুয়ার “ কবিতায় চার পংক্তির মধ্যে কবি কোনো পাহাড় দেখার বিস্ময় লেখেননি, বরং তৃতীয় পংক্তিতে এসে একটি স্টেটমেন্ট রেখেছেন –“আগে শাস্তি পায় তারপরই কেমন ভাল হয়ে ওঠে মানুষেরা”- কবিতার এই অংশটাই আসলে সম্ভাব্য কবিতা-যা একদিকে দৃষ্টিভ্রমকারী সত্য তো অন্যদিকে তার মধ্যেই মাথা ফুটিয়ে আছে মহান এক মিথ্যে! কবি কোনো দাঁড়ি দেননি পংক্তির শেষে ঠিক যেমন শেষ পংক্তি-“ “জিভ খসে যাবে যদি বলি এই আঘাতের জন্য আমি অপেক্ষা করিনি কখনো” –উন্মুক্ত রেখেছেন। কিন্তু কেন? তবে কি তন্ন তন্ন করে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সামনে কবিতার এই প্রতি বর্গ ইঞ্চি দেখলেও খুঁজে পাওয়া যাবেনা অস্তিত্বের সরলরৈখিক কোনো স্থানাঙ্ক? কবিতা দাঁড়িয়ে আছে সাংঘাতিক এক স্থিরতা থেকে যাকে প্রশ্রয় দিলেই অস্থিরতার কথা বলে ফ্যালে। আমি বলব কবিতাটা কবি লিখেছেন সহজ সাবলীল একধরনের অভিজ্ঞতালব্ধ জীবনবোধের অংশ হিসেবে, কিন্তু আমি যে পাঠক, তাই পাগলামি আমার চেয়েও বড় হয়ে ধরা পড়েছে শেষ পর্যন্ত। কবি কি জানতেন না কথার ভিতরকার কথা ! আ কি স্রেফ বাইরের চেহারার বিস্তারিত বিবরণ পড়ে শুনিয়ে বিদায় নিলেন আমাদের কাছে থেকে? একজন পাঠককে অলক্ষেই তিনি ঢুকিয়ে গেলেন পংক্তি অন্তর্বতী সেই প্রায়ান্ধকার প্রকোষ্ঠগুলিতে যেখানে সে সন্দেহ করতে শুরু করবে, একটি পংক্তিকে তার মধ্যবর্তী শব্দকে এবং শব্দের মধ্যবর্তী লুকিয়ে থাকা সারাজীবনকে। আমি বলব কবিতাটার সার্থকতা এখানেই যে ধ্বনিত স্বর থেকে তা আমাদের প্রয়াত পরিচিত স্বরাঘাতের কাছে টেনে আনতে পারে। কবি নিজেও জানেন এই ‘ভালো হয়ে ওঠা মানুষ’ এই ‘অপেক্ষাহীন মানুষ” আসলে শব্দের রাজনীতি- তাঁরও যে চৈতন্য মিশেছে মাংসে এবং তিনি লিখতে লিখতে হয়ত মুচকি হেসেওছেন, ছুরি হাতে তৈরি করেছেন নিজেকে –প্রতিটা মিথ্যে লেখার ভারবহন করতে করতে ফিরে আসার পথে দেখা হয়েছিল হয়ত কোনো পাঠকের সাথে। সেখানে তখন ছিল বৃষ্টি, কিন্তু তা আজ হয়ে গেল রক্ত। হয়ত জেনেবুঝে একজন কবি এটাই চেয়ে নেন কবিতার কাছে- তাঁর নিজেরই শবকে সাজান শিশিরস্নাত মিথ্যে কল্পনা দিয়ে। কবিতাটার মধ্যে কোনো ধাক্কা নেই আঘাত নেই অথচ এই চুপচাপ বসে থাকা একটা কবিতা কত বিপদ্দজনক হতে পারে তা একজন পাঠক জানেন,  তিনিই বলতে পারেন একজন কবি তাকে কিভাবে বসিয়ে গেলেন এমন একটা যাওয়ার দিকে যে যাওয়ার ভেতর ফিরে আসা নেই। জিভ যাতে জড়িয়ে না যায় , যার জন্য শরীর বাজার নিলামদার পেরিয়ে কবি যে কনফেশনের সামনে দাঁড় করিয়েছেন নিজেকে সেখানে রয়েছে মৃত কোনো পৃথিবীর ক্রোকিং ম্যাডনেসগিলে খাচ্ছে। একদিকে জীবন্ত কবরের ব্যাখা দিয়ে হাসতে হাসতে এগোচ্ছেন কবি অন্যদিকে একজন পাঠক হাতে রক্ত লাগিয়ে আরও আরও বেশি সন্দেহভাজন হয়ে উঠছেন নিজেরই শ্রমণের দিকে।

       মাঝে মাঝে মনে হয় , কেবলই কি বিশুদ্ধতার প্রশ্নে আজীবন কবি ঘুরে মরে? সম্ভবত না। কবি হলেন নিশিতে পাওয়া মানুষের মত, কেউ যাকে ভোররাতে ডেকে এনেছে ফাঁকা মাঠে,কে এনেছে কেন এনেছে এর কোনো উত্তর জানা নেই তাঁর , কিন্তু প্রশ্নের ভেতর ঢুকে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। এখন কবির তোলা এই প্রশ্ন কি একজন পাঠকের কাছে কেবল কিছু এলটারনেটিভ রিয়েলিটি! যার সাথে বৌদ্ধিক যোগাযোগ ছাড়া আর অন্য কোনোভাবে পৌঁছোণো সম্ভব না? এখানেও মনে হয় অস্তিত্ব ধারনাটাকে একটা আকাশকুসুম ভাবতে না বসে যদি তার সন্ত্রাসী বাঁকে কবি ও পাঠক দুজনকেই একই রকম বন্দী মনে করা যায় তবে দেখা যাবে স্রষ্টা বা সৃষ্টির প্রস্তাবনা বা নির্বাচন আদতে কখনো কখনো জীবন সম্পর্কীয় বিনির্মাণই সেখানে যে প্রতিধ্বনি আর প্রতিচ্ছবির পৃথিবীটাকে বিছিয়ে দিয়েছেন কবি তাতেই সারাজীবনের প্রশ্নের মত জব্দ হয়ে আছেন একজন পাঠক। ভাবুন না, এক মহান দুর্ঘটনায় পাওয়া জীবন নিয়ে মাঝরাতে অসহায় কোনো এক পাঠককে যদি বসিয়ে দেওয়া হয় ‘কফির দাম মেটানোর আগে’ কবিতাটার সামনে তাহলে কি হতে পারে? কবিতাটার ছত্রে ছত্রে কালো পোষাকে লুকিয়ে রয়েছে ভয়েসলেস পোয়েট্রি, সামনের মানুষটি অচেনা অজানা অথচ কোথাও যেন আমাদের সাথে মিলিয়ে দেওয়া যাচ্ছে তার ম্লানিকে। কফির দাম মেটাবার আগে বিড়বিড় করে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছে যে কিংবা নৌকার মাঝখানে লাল আলোর মত বসে থাকে যে কিংবা জন্মদিনেই যারা জন্মায় বেঁচে থাকে একমাত্র , আপনি কি তাদের কেন্দ্রীয় মোটিফটা বুঝতে পারছেন? বুঝতে পারছেন কি বিপদ্দজনক ভাবে কখন তারা চলে এসেছে আমাদের খুব কাছে! শরীর শরীর ঠেকে গেছে ; কবিতার মধ্যে দিয়ে চরিত্রের সাথে পাঠকের এই যে বস্তুগত একাত্মতা তাই বোধহয় শব্দগুলোকে বন্ধ্যা করে রাখেনা; শব্দের ওপরে হাত রাখলে মনে হয় যেন একটি ছোটো ছেলে তার চাপা চাপা দীর্ঘশ্বাস দিয়ে শব্দের চারপাশে রং করছে আর তারপর নিজের হাতেই সেই রং থেবড়ে দিচ্ছে।হয়ত কোনো এক ক্লান্ত আত্মাকে মুছে ফেলতে চাইছে সে হয়ত জানলা দিয়ে দীর্ঘক্ষণ জীবনের দিকে তাকিয়ে আছে সে অথচ জীবনের থেকে দূরত্ব কিছুতেই কমাতে পারছে না ,মুছে ফেলতে চাইছে সেই মানুষটাকে। কবিতাটার শেষে শ্যাওলা মাখা শোল মাছের মত মুখ গিঁথে আছে ‘কখন ফিরবে’ পংক্তিটি। আমি এই ‘ফেরার’ কাছে এক ঠায় বসে থাকি আর ভাবি কি অদ্ভুত কালার ডায়ভার্সিটি কবিতাটিতে। সাদা বরফ লাল আলো শুকনো রঙের জিভ উজ্জ্বল কফি-আর সব শেষে নিঃশব্দ অথচ অস্তিত্বময় এক ফেরার আকুতি।  এ ফেরার রং কি? না কি এ ফেরা রঙের অতীত, আপাত অভাব রঙের ! একই কবিতায় পাঁচ আঙ্গুলে ধরার মত কতকিছু সাজিয়ে রেখেছেন কবি অথচ তাঁর খোঁজ এই পাঁচ আঙুলের বাইরের অতিজীবিত অন্য পৃথিবীতে।  এই ফেরা কিন্তু কেবল কোনো অনুধ্যানের জগত নয় বরং এ কবির সর্বনাশের পথে পা বাড়ানো যেখানে নিষ্পল সন্ধানের  শেষে বিশাল এক না ফেরার জগত নিয়েই তাঁকে বসে থাকতে হবে- তিনি জানেন, এ আকুতি তাঁর কাছে আর্তনাদের সামিল তবু এই ফ্যাগমেন্ট অফ সিউডো লাইফ কে পেরোতে চাইছেন কবি, পরাস্ত করতে চাইছেন স্বজীবনকে। আর শেষমেশ খুঁজে পাচ্ছি নার্সিসাসের গল্পের সেই ইকোকে যে কিনা কোনো উত্তর নয় বরং একটা উদ্দেশ্য , অন্ধকার জীবন থেকে তাড়া খেয়ে এসেও আলোয় মড়ার মত দাঁড়িয়ে থাকতে হয় যাকে। ঠিক যেমন নার্সিসাস নিজেও আগাম নির্ধারিত একটি মিথ্যে যা কিছুতেই সমূলে উৎপাটিত করা যাবেনা।

       যদি কেউ এখুনি জিজ্ঞেস করে বসে-আচ্ছা, কবিতাগুলি লেখার সময় কবির নিজের সাথে কেমন সম্পর্ক ছিল? না, আমি গোদারের মত বলতে পারব না –‘কোনো সম্পর্কই ছিল না’-তবে অবশ্যই বলব শব্দের রিলগুলো তিনি নিজের দিকে ছুঁড়ে মারছিলেন আর অন্যদিকে নিশ্চল ক্যামেরাটা চালু রেখেছিলেন। ‘কফির দাম মেটানোর আগে’ কবিতাটা কার উদ্দেশ্যে লেখা? তাঁর নিজের? এর আংশিক উত্তর-‘হ্যাঁ’। এর আংশিক উত্তর-‘না’। এই হ্যাঁ আর না এর মাঝে কত শব্দ জুড়ে দেওয়া হয়েছে আর শব্দ জুড়ে দেওয়ার পর পুরো কবিতাটাই রেখে দেওয়া হয়েছে শব্দহীন। লেখাগুলি পড়তে পড়তে মনে হয়েছে লেখক এখানে একজন নন বরং একই সাথে তিনজন, একজন সৃষ্টি করেছেন, একজন সেই সৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করেছেন আর অন্যজন এই নীতিগত আপোসের মাঝে দাঁড়িয়ে প্রতিনিয়ত নিজেরই শবদেহ বহন করে চলেছেন, নিজেরই হেরে যাওয়ার পক্ষে যুক্তি খুঁজে চলেছেন! এই মৃত্যু তো প্রাণহীণ মৃত্যর মত নিঁখুত নয় আবার শিশুর মত সরলও নয় অথচ এই জটিল আবহই দৃশ্য অদৃশ্যের মাঝে রক্তপাতহীন যুদ্ধ করে চলেছে। মনে হয় একজন শিল্পী প্রথম থেকেই নিজের হেরে যাওয়ার এই মৌলিক রংটাকেই আবিষ্কার করে ফেলেন আর তারপর চলে তাকে পুনরাবিষ্কারের খেলা। যে সত্য নিয়ে কবি তৈরি করছেন তার দর্শন তা কিছু বাদেই সমুদ্রপৃষ্ঠার মত আছড়ে পড়বে সমষ্টির দিকে আর তখনই তিনি জলের ওপর হাত তুলে দিতে বাধ্য হবেন কারণ জানেন সব কটা জানলা খোলা রেখেও স্ব হনন থেকে নিজেকে শূণ্যের দিকে পাচার করে দিতে পারবেন না। কবিতাগুলোতে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে এক ধরনের ইনকেপেবিলিটি-স্বগতোক্তির মত হয়েও যা নৈর্ব্যক্তিক- ইনকেপেবিলিটি– টু ব্রেকিং ফ্রি অফ বায়োলজিক্যালি ডিটারমাইন্ড লিমিট– যে স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে আমরা একজন কবিকে আইডেনটিফাই করি আমি মনে করি তা মিথ্যে। বরং কবিতার মধ্যে দিয়ে কবি চূড়ান্ত দাসত্ব পালন করেন এবং এই দাসত্বের চিহ্নগুলো যত স্পষ্ট হয়ে ওঠে ততই যেন কবিতাটা হয়ে ওঠে সৎ। কিন্তু কিসের দাসত্ব? তিনি রোজ ভোরে একটি কবিতার পাশে এসে বসেন তারপর কাঁচি নিয়ে নেমে পড়েন নিজের মধ্যে, খোঁড়েন, কাটেন, করাত চালিয়ে দেন, আগাছা নিড়োন নিজেরই চারপাশে তারপর আবার নিজেরই মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন। এখানেই কবি একজন হেরো, গো হারান হেরো , এবং এই হারই হয়ত তাঁকে আরও গভীর স্তরের প্রতি বিদ্রোহ করার সাহস যোগাচ্ছে। তবে কি এ সবই আত্মজীবনী মূলক কবিতা? আমি বলব , না। আসলে কবিতাগুলোর মধ্যে দিয়ে কোথাও অন্য আর একজন মানুষকে খুঁজে চলেছেন কবি ,হয়ত তাঁরই মত দেখতে তবে ,তবে তাঁর অন্তরাত্মাহীন শেকড়হীন সত্তার মত নয় বরং সে মানুষটার পৃথিবী অনেক বড়ো , যা বহুকাল কেউ পরিচর্যা করেনি ,যেখানে কেউ কোনোদিন পা রেখেছে বলে মনে হয় না। সেই পথের দিকে সেই পৃথিবীর দিকেই তাঁর চিৎকার এবং এই চিৎকার নিষিদ্ধ, নগ্ন হবার যোগ্য, মানুষের চামড়ার বাইরে এসে এই চিৎকারকেই যেন খুঁজতে বেরিয়েছেন কবি।

       এই সেই চিৎকার, বরফের পাহাড় পেরোতে গিয়ে ঠান্ডা লেগেছে যার বুকে। এই সেই চিৎকার -‘যে বাড়িতে দরজা নেই’ কবিতার বুকে কান পাতলেই শুনতে পাবেন যাকে । কবিতাটার কাছে এসে প্রাথমিক ভাবে মনে হতে পারে -‘সামথিং লাইক এ গুড আর্ম চেয়ার,ইন হুইচ ওয়ান রেস্ট আফটার ফিজিকাল ফ্যাটিগ’। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এই চেয়ারে বসে বসেই কবি আমাদের আইসোলেটেড করে তোলেন, পাঠককে প্রশ্ন করাতে বাধ্য করেন তার অবস্থান ঠিক কোথায়! স্ব এবং সময়ের মাঝের থিন শিট অফ গ্লাসটাকে আইডেনটিফাই করানোই যেন তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু চিনিয়ে কি হবে? দ্বিধা দ্বন্দ্ব সংশয় থেকে নিমগ্নতায় পৌঁছোনো? শাদা ভাবনায় পৌঁছোনো? পাঠক হয়ত ভাবতেই পারে কোনো পুরোনো বাড়ির ধ্বংসাবশেষের ওপর কবিতাটার সেট লাগিয়েছেন কবি। যে গল্পের শুরুতেই হয়ত স্মৃতি আর নৈরাশ্যের আবহ তৈরি হয়েছে। আবার হয়ত এসব গল্পই একজন আলোচক বা একজন পাঠকের মিথ,অথচ মিথ সত্যের খোঁজ না দিলেও সম্পূর্ণতার একটা গূঢ় বক্তব্য জানিয়ে তো যায় ! আসলে কবিতার উদ্দেশ্য কোথাও নেই, তার লক্ষ্য কোনোকিছুই নয় কেবল সম্পূর্ণ হয়ে ওঠার প্রয়োজনই তার প্রয়োজন। আমাদের ফিজিক্যাল এক্সিটেন্সটা যতটা সহজ সাইকোলজিকাল সেলফ ততটাই কমপ্লিকেটেড-যেন তার গভীরতা আর যুক্তিবহতা দুই গুপ্তচরের মত নিজেই নিজের মনে পোকা হয়ে বসে থাকে, খুঁজে ফেরে সেই আগুন, সেই শূন্য করিডোরে ফাঁপা পায়ের শব্দ, সেই চেপে চেপে বের করতে না পারা বদ রক্তগুলোকে – দীর্ঘ চলমানতার মাঝে এই একটি মাত্র দীর্ঘতর আঁধার আর তাই কবির সযতন নির্মান হয়ে ওঠে। পুরো কবিতাটায় একটা অদ্ভুত বিরোধাভাস আছে ধাক্কা দেওয়া এবং না দেওয়ার প্রেক্ষিতেএকটি দরজা- শুরুতেই যাকে ধাক্কা না দিয়ে তুমি কিছুতেই ঢুকতে পারোনা, সেই কবিতার শেষ পংক্তিতে এসে হয়ে যায়- ধাক্কার দরকার নেই, যাও ঢুকে পড়ো। এই একটা ‘ধাক্কা’ই কিন্তু এখানে গোটা একটা কবিতা, আক্ষরিক অর্থে শব্দের খন্ডহার বলা যেতে পারে, যেখান দিয়ে একমাত্র একজন সৎ কবির মাথা গলানো সম্ভব। এই ধাক্কাই হয়ত কবির সারাজীবনের একমাত্র অন্তর্মুখ যা দিয়ে যাপনের রহস্যনিকেতনকে অতিক্রম করতে চান তিনি, এই একটা ধাক্কার জন্যই হয়ত তাঁর জীবনকে গ্রহণ, যাপনকে নিয়ে এত কথা বলা, বেপরোয়া বরফের ওপর কিংবা হলুদ অন্ধকারের ভেতর অপেক্ষা করা ; কোনোদিনও দরজা খুলতে পারবে না জেনেও একজন কবি সারাজীবন এক অলৌকিক ভিক্ষাপাত্র নিয়ে বসে থাকেন যেন এমননই একটি ধাক্কার জন্য। এবং এই একটি ‘ধাক্কা’ই কবিতাটাকে নিয়ে এসেছে আঁধার আলোর মধ্য অংশে। দরজা না থেকেও একটি ধাক্কার জন্য সম্ভাব্য সব লৌকিক দরজার ছবি এঁকেছেন কবি , ইমেজগুলিকে কনসিভ করিয়েছেন অস্তিত্ববাদী জিজ্ঞাসার থেকে এবং তিনি খুব ভাল করে জানেন সংযুক্ত স্মৃতি থেকে এই যে রিয়েলিস্টিক একটি দরজার প্রতীক তার ফাঁক দিয়েই জিভ ভেঙাচ্ছে একধরনের ঐশী নির্মাণ, যা তাকে চেতনার অর্জন দেবে , এনে দেবে শূন্যের দিকে স্বপ্নের ঝাঁকুনি। সারাজীবন ধরে একজন কবি যে আলোকিত রাস্তার জন্য মাথা খুঁটে মরেন , তাঁর অস্তিত্বের মধ্যে নিঃশব্দে বহন করেন অনস্তিত্বের আলো বাতাস তা ওই দরজার ওপারে তা ওই ধাক্কার শেষে। জানিনা, একজন সামান্য পাঠকের প্রতিমূহূর্তের ভয়কেও এই ধাক্কার সামনে বাতাস জমে ওঠা দরজার সামনে এনে গৌণ করে দিতে পারেন কিনা কবি কিন্তু এটা নিশ্চিত সামান্য পথিকের কাছে এ এক তীব্র অসহ্য ইশারা, যা বন্ধনহীন পথিকতার দিকে আঙুল তুলে বলে চলো, আরও একটু চলোএখানে মনে পড়ে যাচ্ছে সুবিমল মিশ্রের ‘সত্য উৎপাদিত হয়’র একটি অংশ –“শূন্যতার কোনো কেন্দ্রমূল নেই আর শূন্যতার সীমা হল শূন্যতা। আবার শূন্যতাও ফাঁকা, vaccum, এক জিনিস নয়। কেন না শূন্যতা যা আছে তার চাইতে কিছু কম হতে পারে না। যখন কোনো কিছু ফাঁকা হয় তখন তাকে ঘিরে থাকে স্থান,spaceকিন্তু স্থান ছাড়াও শূন্যতার অস্তিত্ব আছে, আর সেটাই বড় কথা।“-যে পাঠক নিত্য সীমানা মেনে চলাই বিধেয় বলে বেঁচে থাকে তার সামনে কবিতাগুলো এই ‘স্থান ছাড়া শূন্যতার’ এক বিপদ্দজনক চড়াই উন্মুখ করে দিয়েছে। ঈশ্বর প্রেরিত নয় কোনো কবিতাই কিন্তু তা পাঠকের প্রেরণার কারণ অবশ্যই হয়ে উঠতে পারে কখনো কখনো। স্পেস-টাইম নিরিখে যা অপেক্ষা থেকে পাঠককে নিয়ে চলে এক আপেক্ষিক অনুসন্ধানযাত্রার দিকে যেখানে যাত্রা কেবল তার নিজের ভেতরে যাত্রা, নিজের ছায়া পেরোনোই  একমাত্র কামনা এবং সত্যি কথা বলতে কি পাঠকের মৃদু হাত ধরে একটি কবিতা তাকে নিয়ে এল বড়ো একট মুক্তাঙ্গনে, তার মনে পুঁতে দিল সংশয়ের বীজ -যেখান থেকে মরিয়াভাবে একটি বিস্ময়ের জন্য একটি ধাক্কার জন্য অপেক্ষা করবে সে– আবার সৃষ্টির সাথেই জড়িয়ে আছে সীমাবদ্ধতা। বরং সীমাবদ্ধতাটাকে অতিক্রম না করতে পারার ঠান্ডা স্বীকারোক্তি; কে জানে শিল্পচর্চা কি শেষমেশ জীবনব্যাপী এক ধ্বংসের উৎস! যেখানে একজন শিল্পী নিজেকে নিজের কাছে হারতে দেখে সৃষ্টি করে নতুন এক চরিত্র ! তাকে দিয়ে দেন পাঠকের হাতে, শুরু হয়ে যায় নতুন খেলা, পুরোটাই যেন ধ্বনি প্রতিধ্বনির খেলা, একে ওপরের উপস্থিতিটুকু ছুঁতে পারেনা অথচ এই অনুপস্থিতিই আবার অনেক বেশি তাড়িত করে একে অপরকে। কবিতা সেখানে কাজ করে সিঁড়িতে একটা হালকা পায়ের শব্দ বা দরজায় মৃদু টোকার মত-যা বারবার নিজেকেই প্রশ্ন করায়,- দেখনি? দেখতে পাবে। অপেক্ষা কর !দেখতে পাবে! এই আস্তিত্বিক প্রশ্নেই পুরো একটা অস্তিত্বের প্রমাণ লোপের প্রচেষ্টা করতে চাইছেন কবি , অথচ,অথচ, ইকো কিংবা নার্সিসাসের মতই শেষমেশ তিনি একধরনের বিকারের প্রবক্তা, নিজের ছায়া থেকে বেরোতে না পারার বিকার। কৃষ্ণগহ্বরকবিতাটাকে দেখা যাক ছায়াকে আলোর সম্মতির অপেক্ষা রাখেননি তিনি কবিতায় ভাবনা লুকোবার বিশাল বড় একটা জায়গা আছে আর তা হল প্রতীক ছায়া ছাড়া আলো কোথায়? আর পাঁচজনার মতোই একজন কবিরও এ ভাটি পৃথিবীতে থাকা এবং ফুরিয়ে যাওয়া দুধরনের খেলাই অজানা ,কিন্তু কিছুতেই তিনি নির্বিষ হতে পারেন না। তিনি ঘুমোতে চান অথচ ঘুমের মত খন্ড নীরবতা ব্লটিং ধোঁওয়ার গন্ধে ভেঙে যায়।সে মূহূর্তে তিনি নিজেই নিজের চোখের সামনে বিকল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। আসলে এই নিষ্ফল ক্রোধের ভেতর গল্প চলে একজন শিল্পীর একজন কবির নিজেকে হত্যার।কবিতার টূকরোগুলোকে জড়ো করলে দ্যাখা যাবে মানুষ নয়,কিছু ফুরফুরে মেঘের দল মানুষের হয়ে এক্কাদোক্কা খেলছে।সময়হীন সে খেলা। মানুষ নয়, তার নিচের অন্ধকারটাকে দোলাচ্ছে, ছায়া নিয়ে খেলছে। যেন মনে হয় আশা শব্দটাই মিথ্যে,সাংকেতিক, নেই, আবার মিথ্যেও নয়, যেন আছে কোথাও না কোথাও, যেন সে এই জগতসংসারে একটা রাস্তা। আবার কোনো রাস্তা ছাড়াই তো এ জগত সংসার শুরু হয়েছিল ,শুরু হয়েছিল কোনো দরজা ছাড়াই, একদিন অনেক লোক যা দিয়ে হাঁটতে লাগল তাই হয়ে গেল রাস্তা, যা দিয়ে ঢুকে পড়ল পরিত্যক্ত ঘুম নিয়ে সারারাত পাহারা দেবে বলে জীবন নামের একটি দ্বিখন্ডিত প্রণালীকে তাই তো হয়ে গেল দরজা। একজন কবি একজন শিল্পী হঠাতই হাতকড়া ফেলে এরই ভেতর হত্যাপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এক উন্মত্ত অপভ্রমণ থেকে বেরোতে নিজের ধ্বংসকেই চেখে দেখতে চান তিনি। আসলে তার একটাই কাজ ঠকানোএবং সেটা নিজেকে বিভ্রম তৈরি করা, নিজের চারপাশে , এবং তা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারা

       কবিতা লিখতে বসে কবি সেই খেলায় মাতেন যে খেলায় ঈশ্বরের স্থান নেই ! আবার যে খেলায় আপাত ইতি বলে কিছু নেই মানে কবিতা লেখার আগে কবি হেরে বসে আছেন সত্যিই কি কবির কোনো গন্তব্য আছে? আমার মনে হয় না একটা দীর্ঘ ভ্রমনের মাঝপথে তিনি থেমে গেছেন অনেক আগেইকিছু অদ্ভুত মানুষ আর কিছুটা অদ্ভুত ভূখন্ডের মাঝে দাঁড়িয়ে তিনি নিজেকে নিস্পৃহ দেখাবার চেষ্টা করলেও বারবার পরাজিত হচ্ছেন তবে এই পরাজয় হয়ত খুব জরুরি ,কারন এই স্নায়বিক অভাব না থাকলে আত্মজিজ্ঞাসা থাকবে না যে, আর এই আত্মজিজ্ঞাসা তা হল সেই অসুখের মত যা ভেতর থেকে নিংড়ে দেয় সত্তাকে।  কবিতার অর্থহীন থাকাটা খুব জরুরী, কারণ কবিতা দেহ খুঁজে পেলে কবি কেন তাকে খুঁজবেন,উন্মাদের মত কেন আছড়ে পড়বেন তার প্রতিটা শব্দআকরে! নিঁখুত হয়ে ওঠা কবির কাজ নয়, বরং নিঁখুত না হতে পেরে নিজেকে হত্যা করতে চাওয়া আর হত্যা করতে না পেরে বোকার মত শক্ত হয়ে ওঠা কবির এক এবং একমাত্র ক্যাথাসিস। ‘হাশ ইউ বেবি’ কবিতায় কি আছে?আছে একধরনের রেচন, না, পুরোপুরি নিঃসরণ না হতে পারার একধরনের জড়ানো শব্দ। একই রাস্তায় কবি দাঁড় করিয়েছেন দুটি বিপরীত চরিত্রকে যাদের শরীর কোনও দিনও একে অন্যের পোশাক পড়ে না অথচ তারা টের পায় একে অন্যের নির্যাস,স্বীকার না করলেও জানে ব্যধিলিপ্ত মানুষের বেঁচে থাকার অতিনাটকীয়তায় লুকিয়ে থাকা প্রতিটা ছায়ার গল্প। অথচ সে গল্প বলা বারণ, কবি মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দেন কারণ একটি রক্তপাতের গল্প অনায়াসে আলোপৃথিবীর গা থেকে খুলে নিতে পারে আলোময় ওভারকোটের বোতাম। আর তখন সে অন্ধকার দেখার সাধ্য আমাদের নেই। কারন নিজের কারায় অবরুদ্ধ আমরা, মুক্তির চুক্তি নিয়ে কোন হাত এগিয়ে আসবে না আমাদের দিকে এবং কবিতাটির মধ্যে রয়েছে ডিসগাইজ, ডিসেপশন, যেখানে একটি মৃত্যু একটি মৃতদেহ জীবিতকে বাঁচিয়ে রেখেছে নির্লজ্জভাবে। যান্ত্রিকভাবে একজন শিল্পী একজন মানুষ, প্রাথমিক ভাবে স্রেফ বেঁচে থাকা ছাড়া বেঁচে থাকার তার আর কোনো আলাদা ঘর নেই, যা আছে তা এই মিথ্যে বেঁচে থাকাটাকে সন্দেহ করা, আর যখন তিনি নিজের ভয়কে দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে হেঁটে যেতে পারেননা তখনই শুরু হয় এস্থেটিক ডিসকমফোর্ট । কবি মুখে আঙুল দিয়ে থামিয়ে দিতে থাকেন তার অপসারনের গোপন চুক্তি।

       দশ দশটা কবিতা পড়ার পর মনে হল কবিতা গুলোয় আপাতভাবে একজন হেনরি আছে, ক্রিস্টোফার আছে একজন, কোথাও একজন লিভার বিক্রেতা আছে তো কোথাও আছে একজন মৃত্যুদন্ডের বিচারক। না, একজন না, এরা সবাই পিছু নিয়েছে একাধিক রূপে একাধিক নামে, পংক্তি গুলো পড়া শেষ করে কয়েকমূহূর্ত থামলেই বোঝা যাবে এদের সমবেত প্রতিধ্বনির চিৎকার, প্রচন্ড শব্দব্রহ্মের মধ্যে যারা ধেয়ে আসছে স্মৃতিভ্রষ্ট শূন্যের কঙ্কাল নিয়ে। ননাকিন্তু কবি কোথায়? আছেন আছেন প্রতিটা শব্দের শবদেহ কাঁধে নিয়ে আর পাঠক? সেও আছে, একটা গোলাকার ঠান্ডা আয়নার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে যে আয়নার দিকে তাকাতে তাকাতেই একদিন ইগোর সাথে ভাব হয়ে গেছিল কবির।  মানে ওই মরুভূমি আর বালিঝড়ের সাথে বরফের আর কি! কিন্তু ভাব তো হলএবং এরপর যেটা হল কোনও যুক্তিসংগত কারন খুঁজে পেলেন না তিনি , যে কেন ভাব হল! আশপাশ থেকে অনেকেই বললেন কবি নাকি ওই আয়নার মধ্যে দিয়ে পান্ডুলিপি নিয়ে তার গন্তব্যের দিকে যবেন কিন্তু সত্যি কি তাই? আমার তো মনে হয় ওসব গন্তব্য টন্তব্য কিছু না, একটা আয়না, স্রেফ একটা আয়না, কবির ভাঙা শিরদাঁড়ার দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে আর মিথ্যে মিথ্যে কবিকে তার আস্ত চেহারাটা দেখিয়ে হাসছে কিন্তু কবি জানেন তিনি ভাঙা,সাদা মাংসের ওপর লাল ফুল নিয়ে মূল্যহীনভাবে আত্মসমর্পিত, জানেন ঘন শীতের মধ্যে দিয়ে যেদিন তিনি ফিরে এসেছিলেন ,তারপর অনেক আলোতেও নিজেকে আর খুঁজে পাননি,অথচ ওই আয়না, তাকে রোজ বোঝায় এই তো তুমি এবং শেষমেশ যে প্রতিবিম্বকে নিজের বলে মনে করেছিল কবি তার থেকে দূরে সরতে থাকেন তারপর সরতে থাকেন নিজের থেকে দূরে এবং এখন কবিতাগুলি লেখার মূহূর্তে নিজে বেঁচে আছে কিনা তা বুঝতে হলে একমাত্র তার নিজেকে ছুরি মারা ছাড়া কবির কাছে আর কোনো পথ খোলা থাকেনাশব্দ হল সেই ছুরিযা নিয়ে কবি একদিন নির্জনে এসে দাঁড়ালেন, আর লিখে ফেললেন

রাস্তা চিৎকার করত, প্রতিবাদ করত প্রকাশ্যে
যদি না তাকে আমি আড়ালে এসে চুপ করিয়ে দিতাম

       -এই হোলো কবিতা টেবিলে ঝুঁকে ছুরি হাতে একজন কবি যেখানে প্রস্তুত প্রতিটা শব্দের শেষে নিজেকে হত্যা করতে হ্যাঁ, কবিতা একটি মৃতলিপি তার দেহে চিত্রিত মৃতশরীরের নামকেবল প্রতিধ্বনি আর প্রতিচ্ছবি ব্যতিরেক কবিতার কালো কফিনে কবি যে আর কিছু বহন করতে চাননি

       একেবারে শেষ কবিতা ‘কৃষ্ণগহ্বর’ এর শেষ লাইনে দাঁড়িয়েই হয়ত আমরা জানতে চাইব কবির নাম পরিচয়। কিন্তু কি হবে? নামের মধ্যে দিয়ে হয়ত একটি মাথা খুঁজব আমরা ,খুঁজব একটা কালো টুপি অথবা  অন্ধকারে পেঁচার মত চেয়ে থাকা সেই মানুষটাকে যে কিনা বুক অবধি তৃষ্ণার্ত আর নিষিদ্ধ বিছানা পেতেছে । বরং অপেক্ষার জন্য তৈরি থাকা অথচ অপেক্ষা না করার মত একটা ন্যারেটিভ জার্ককে যিনি জরুরি পরিসর করে গেলেন পাঠকের কাছে তাঁর কাব্যিক স্ট্র্যাটেজি, তাঁর এস্থেটিক প্র্যাকটিসের কাছে শেষমেশ ব্যক্তিসত্তা গৌন হয়ে যায়। এই পরিসর তৈরি করে দেওয়া আসলে একধরনের উদ্ভাসন, যে হারিয়ে যাওয়াকে সারাজীবনের ভয় সেই হারিয়ে যাওয়াকেই তা ভাব করে তোলে। এই সেই মেন্টাল রুফটপ যেখানে একজন কবি তাঁর পাঠককে ছেড়ে যান একা, সম্পূর্ণ একা, তাকে জানিয়ে যান একা হয়ে যাওয়ার মত একটা দূরত্ব থেকেই একমাত্র ‘দেখা’ সম্ভব। বেঁচে থাকার চেয়ে ফিকটিশাস থিং আর কি হতে পারে? যতই তাকে সাহিত্য দিয়ে শব্দ দিয়ে বেঁধে রাখার বাঁধিয়ে রাখার চেষ্টা করা হোক না আসলে ‘লাইফ ইজ এবস্যুলিউটলি আনরিয়েল ইন ইটস ডায়রেক্টলি রিয়েল ফর্ম’! কবি প্রথমে সমাজে থাকেন, তাঁর প্রতিবিম্বকে নিজের বলে মনে করে্ন, তারপর ধীরে ধীরে সেই আস্তিত্যিক স্থায়ী দরজাটা খুলে  সকর্তৃত্ব অনুপ্রবেশ করতে চান এবং যথারীতি হেরে যান, জীবনের বাইরে যেতে চেয়ে বেশি করে প্রোথিত হয়ে যান জীবনের ভেতরে –এবং এখান থেকেই উঠে আসে আত্মসমর্পনের প্রতিভাষা। যা নার্সিসাস বা ইকোর মতই স্থির, জলে নিজের প্রতিবিম্ব বা বাতাসে নিজের প্রতিধ্বনি দেখে আর সাদা বরফের মত প্রত্যাখানে স্থির হয়ে যেতে থাকে তার হাড়গুলো জমাট তুষারের মত পাথর হয়ে যাওয়া অবধি। রয়ে যায় স্রেফ নিজের সাথে যুদ্ধ করে হেরে যাওয়া প্রতিধ্বনিরা।


       জানিনা ,কবি নিজের সেই প্রতিচ্ছবি আর প্রতিধ্বনির প্রমাণ লোপের চেষ্টাতেই পাঠকের সামনে নামিয়ে রেখে গেলেন কিনা ক্রিস্টোফারকে! আর হয়ত নিজের পরাজিত ভারী কাঁধ আর জীবন জুড়ে লেপ্টে থাকা অসহনীয় হাসির থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে কানে কানে বলে গেলেন -“প্রতিটা তলোয়ারের গল্পে নতুন জামা সমেত/আমি তোমাকেই বসিয়ে রাখব ক্রিস্টোফার”...

৩টি মন্তব্য: