রুমালচুরি- ১৩



  

       কবির নাম, বয়স, লিঙ্গ, ঠিকানা ইত্যাদি যা কিছু কবিতার জন্য জরুরি নয়, তা আমরা মুছে দিয়েছি। আর এভাবেই ১০টি কবিতা পাঠানো হয়েছে অন্য এক কবির কাছে- আলোচনার জন্য। শুধু ১০টি কবিতা, আগে পরে নাথিং। আমাদের সাথে রুমালচুরির এই খেলা খেললেন ১৯ জন কবি।


       এখানেও কবির নাম ছাড়া ১০টি কবিতা রাখা হল, সঙ্গে থাকলো আলোচনা। কবির নাম জানার রাস্তা কবিতার নীচ দিয়ে গেছে। তবে আমরা বলবো রুমালচুরির এই খেলায় আপনিও থাকুন। কবির নামটা না হয় একটু পরেই জানলেন।




  ১০টি কবিতা


   উৎসর্গ


যৎসামান্য মহীয়সী আমার, সময় উস্তম ঝুস্তম করে হেঁটে যাচ্ছে একমনে খোলা বিকেলের দিকে। একহাঁটু ঘুমের ভেতর থেকে উঠে আসে তার গাঢ়তম ঘ্রাণ আমার দু আঙুল কালির বদলে যাতে ভেজানো রয়েছে। আর নড়িচড়ি আঁকিবুকি কাটি, কলমে ভরাট মানুষ আমি, জড়িয়ে ধরেছি একটি কার যেন, বা কে আগলে রেখেছেখালি উচ্চারণ বেঁকে উঠছে মায়ার দুদিকে

এমনি প্রেমের লেখা-

আমার না, মাঝে মাঝে, কখনো অন্য কোনো মনস্কতার মাঝখানে হঠাৎ করে যখন মনে পড়ে আমার একটা সো-দেন-পিঁপড়ের-কিতিমিতি-গোধূলি-এ্যাডিক্ট-স্ক্রু-খোলা গার্লফ্রেন্ড আছে, যাকে কিঞ্চিত কিঞ্চিত, কূঞ্জম কূঞ্জম হলেও আমি তার নিহিত গভীরটিকে চিনি, যে অবোলা গাভীর মতো অখন্ড কৌতূহল ছাপিয়ে রেখে চোখে আমার দিকে তাকায়, আমাকে আমার নিজেরই একটা সুক্ষ্ম অঘটিতপূর্ব্ব গর্ব এফোঁড় ওফোঁড় করে চলে যায় যা এক তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ ঘরানার সুখ জন্ম দেয়। গর্ব বা অহঙ্কার কিসের তা এখন বুঝি না, তবে আমার এই বিশেষ প্রেমিকাটিকে নিয়ে অহঙ্কারের মর্ম ঘাঁটতে গেলে একটু ঝালচন্দ্রমার ন্যায় রুক্ষ্ম জ্যোৎস্নার উত্তরীয় ছাড়া কোনো সুতোর হস্তাক্ষর না রেখে লেখার কাছে আসতে হবে।

এমনি প্রেমের লেখা-

আদরখাকী নামের একটি আমের পাশে ঘর করেছি গ্রাম রেখেছি, ঘাম ফেলেছি, শোনা যাচ্ছে উলুধ্বনি সম্ভবতঃ লক্ষী আছেন আকাশগুঁড়ো ঘটের মধ্যে চালের দোয়াত একচালা ঘর, পুঁইমাচা বর, এই নিয়ে বড়ো সংসারে পায় আলতাভেজান মেঘের দিনে, হে নারায়ণ আদরখাকী আমের ধারে, সলতেপোড়া জামের ধারে, সিঁদুরকৌটো নামের পারে ঘোমটা মাথায় যে কলাগাছ অম্বুবাচীর দিন গুনছেন গণেশ আসেন মর্মভেদী, কুলুজী, ঠিকুজী কোথায় গেলে মাঠের ধারে গ্রামবুড়ী, মাঠের মতোই যে মন্দিরে থমকে আছি, হে দুর্ব্বাঘাসের শয্যা পাততে, যে এসেছো উপড়ে নিও

এমনি প্রেমের লেখা-

দেখেছি ফুলের পালকি বিছানো আছে পথে কুসুম কাহারেরা হাঁক ছাড়ে
রাস্তা খুঁজছে মধুসিক্ত কারুকার্য কোনো একা, সে বুঝি তোমার গহন হতে নিঃসৃত
তার ডাক বাজে ধা তে টে ধা ধি না, না তেটে তা তি না তালে, দ্রুম নাচে আকাশে বিস্তর
পক্ষী প্রবেশিল বহতা খাঁচায় তা বুঝে নিতে নদীতে বেগ ঘনায় সুরা জমে চোখে
গন্ধভ্রুণ কোনো হাওয়াতে ঘুরছে খুব, একটি রোঁয়া পেলে যেকোনো ধানের, সীতাশাল বা গোবিন্দভোগ, ধরে যাবে তাতেতুমি খুলবে শুভ্র ধানের হাড় ভাত আমার দেহ থেকে
সঞ্চরনমান কোনো দিগন্তফলের বাগান হুমড়ি খেয়ে পড়ে, আলতা বানানে হঠাৎ
আলতো ভুল গেঁথে যায়, খই এর চালের মতো বালির খোলায় তপ্ত তপ্ততর হয়ে
শব্দ ফুটে ফুটে ফেটে যায়, মুড়িরা লাফায় মৃৎপাত্র অনলনন্দিনী হয়ে জাগে

এমনি প্রেমের লেখা-

চুলের ঝামেল নামে অতর্কিত প্যান্থার যেন
শুকায় সরসী অতসী দু বোন জন্মাবধি ভেজা কালোমঞ্জরী
জোনাকি চালিয়ে যারা নিজ তৃণভূমি খোঁজে
সেখানে কোথায় খসে গেছে নাকের ফুল, কানের শিশির
মথিত তুরুপ জেগেছে যেন
দর্পনারায়ণের বধূ প্রবল ঝর্ণা, আর খোলা অহমসকল
ভ্রুণতলে ধুলো ধুলো টুপু টুপু পায়ে
আসে কোকিলদরিয়া এমন শব্দের কূহু জেগে ওঠে খালি ওষ্ঠস্পর্শ করে

এমনি প্রেমের লেখা-

হিহিহি পাগলী আমার, বুনো পাগলিনী
শঙ্খ গুমরে ওঠে ভ্রুনীল রঙের তুলি
শরীরে বুলিয়ে যায় বিহু, বিহুকূঞ্জ গাছের দেবতা
আমি দরবেশ আবাহন ছেড়ে রাখি, আলতো হাতে
নামাই নদীর আবরণ মৃদু মেহেকের দাঁড়ে
দাঁড়ে জমে যায় জলীয় দোয়েল, পানির টুনটুনি
জলীয় সুরমা ধূম ধূম ভরা ঝরাজ্বর নিয়ে আসে
না হয় পাণিগ্রহণে অক্ষম, তা বলে কি তেষ্টা পায় না তার
নদীটির কিনার কাকুতি

এমনি প্রেমের লেখা-

চোখের পাশে কাঁচের ঘোরাফেরা
সে পদপক্ষেপ চিহ্ন দেখেছি আমি জিহ্বাসঙ্কুল
এভাবে গেঁথে যায় স্বচ্ছতা, এভাবেও স্বচ্ছতম গেঁথে যেতে পারে?
দেহভরা দু চোখে তাকাও আয়ত আবার ফের
দেখ কেমন গাঢ়, প্রগাঢ় দ্রুম এসে ম্লান মুছে দেয় চরে
নৌকোভর করা অকূলের দ্রিদিম গেঁথেছে আজ
চাঁদ আর জোৎস্নার মাঝামাঝি স্বচ্ছ জলাধারে

এমনি প্রেমের লেখা-

তোমাকে দু হাতে করাঞ্জলি করে শব্দ তুলে দিই
শব্দে ভরে দিই যা কিছু ফাঁকা আছে দেহে, মুখ চোখ নাক নাভি নিম্ননহবতখানা
দু বাহু অঘোরে সন্ন্যাসী গাঁট বেঁধে রাখি
কৌপীন মুগ্ধ করে নতজানু হই বাক্যবিধুর ডালিমের মতো আছড়ে পড়ি চরে অগোচরে

তোমাকে কৃতাঞ্জলি করে শব্দ ঝরিয়ে দি
অসংখ্য স্নান খুলে নক্ষত্র তাকায় আকাশের রোমকূপ থেকে দেখো তুমি

তোমাকে অসংখ্য শব্দ ঘটিয়ে ভরি পিতলের ঘট দু খানি

এমনি প্রেমের লেখা-

অর্থাৎ ছাদদগ্ধ হয়ে আপনি ঘটে উঠছেন এই মুহূর্ত্তগৃহে।
তোমাকে আপনি না বলে বলি প্রতিটি মুহূর্ত্ত আজকাল আমি বাড়ির মতো দেখি, ঘরের মতো দেখি। যখন চোখের থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে থাকে আলোকিত পর্দা আর পর্দার ওদিকে কয়েক ইঞ্চি দূরে থাকে তোমার চোখ। একই মুহূর্তে দুজন চোখ একই আলোকিত পর্দা পাঠরত, না সরিয়ে। কি আশ্চর্য সংযম নয়? সঙ্গমও তো বটে। একই মুহূর্তে দুজন চোখ একই আলোর কণিকাস্রোত ধারণ করছে মণিতে। যেন জলপ্রপাতের তলায় চোখ পেতে হেসে উঠছি দুজন। এখানে আলোকপ্রপাত। এভাবে ভাবলেই, মুহূর্তে ছাদদগ্ধ কোনো কালোমগ্ন তুমি আর তোমার থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে পর্দায় আছড়ে পড়া চোখ। তার এদিকে কয়েক ইঞ্চি দূরে আছড়ে নেওয়া নয়ন আমার। দুজনেই পাঠরত। এইসব মিলেমিশে একাকার হয়ে কিরকম সমস্ত ইঞ্চি আলোকবর্ষ হয়ে যায় আর পর্দার এদিক ওদিক মিলে এক শোয়ার না না পালঙ্ক রাখার ঘর হয়ে ওঠে। এক একটা মুহূর্ত মনে করি আমি, ধরা যাক, সাত বাই পাঁচ আলোকবর্ষ মাপের একটি ঘর। যেখানে দুটো কিম্ভূত নক্ষত্রের মত দুজন বসে আছি বা জ্বলন্ত হয়ে আছি। যা তুমি জোনাকি ভাবছো সে আর কিছু নয় তোমার নক্ষত্র থেকে ছিটকে ওঠা প্রজ্জ্বলন্ত প্রাণের টুকরো। আপনার কালোজাম গাছ, শিকড় ঢেকে যাওয়া, এসবে ছাদদগ্ধ আপনি ঘটে উঠছেন। নিদ্রা উদ্যত লাগে? লাগে? আর লাগবে না মরহুমা, তোমার সিঁথির সরু পথে আমি এই মুহূর্তে রেখে দিলাম আমার চেরাগ। মরহুমা এই তো তুমি আমার কোলে বসে আছো কবরে বৃষ্টি দেবে বলে। তোমাকে আপনি না বলে বলি প্রতিটি মুহূর্ত্ত আজকাল আমি বাড়ির মতো দেখি, ঘরের মতো দেখি।
ছাদদগ্ধ তুমি কি কখনো ভুলিতে পারো কূঞ্জে শ্রীমতী এক কারু। কারো।

এমনি প্রেমের লেখা-

কি আশ্চর্য রাত্রি……
জীবনের প্রথম দাবীটি একটি দেবী আমায় দিলেনআর আমি জোৎস্নাঘুঁষিতে কাতর, দাবীর পাশে পড়ে আছি শান্ত দাওয়ার মতো, গুটোনো শীতলপাটি পাশে। কখন আসবে শ্রীচরণ, বুকে পড়বে লক্ষী লক্ষী পায়ের ছাপ। কারু, কারু….
#
আগে এরকম দেখিনিএই বাক্য ঘটে ওঠে বারম্বার, তাই দেখা যায় না কখনো ফুল ফোটার আগে কি করে পুষ্প প্রস্ফুটিত হয়এই কথা বলে আমি একটি রজনী নামিয়ে রাখি তোমার গন্ধে






  এমন প্রহরে আজ নতুন কী কথা বলা যায়
আলোচনা করলেন অনিমিখ পাত্র  

       কবিতা সম্পর্কে গাঢ় হয়ে এসে কিছু বলতে গেলেই আজকাল কানের মধ্যে বহুশ্রুত আপ্তবাক্যগুলি ভন্‌ভন্‌ করে। বিরোধ হয়, স্ববিরোধ হয় আর আমি দেখি কেবলই ঘাবড়ে যাচ্ছি, স্থির কোনও সিদ্ধান্তের কাছে কিছুতেই পৌঁছনো যাচ্ছে না। অথচ লেখালিখির হাতেখড়ির সময়কালে পথ এতো পিচ্ছিল মনে হয়নি তো !

       এই যেমন, কেউ কেউ বলেন, আজ আর নতুন করে শিল্প সাহিত্যে বলবার নেই কিছুতাহলে নতুন লেখা জন্মাবে কেমন করে? দেখাবার কায়দাতেই তার নতুন, তার সার্থকতা। অর্থাৎ কিনা বক্তব্য নয়, ভঙ্গিমাই সার।

       আরেকটা তর্ক হয়, লেখকের, এক্ষেত্রে, কবির সিগনেচার নিয়ে। কোনও লেখার নীচে যদি কবির নাম নাও দেওয়া থাকে, তবু যদি লেখাটিকে চিনে নেওয়া যায় সেই নাকি কবির সার্থকতা, তার নিজস্বতার প্রমাণ। এখন, এই সিগনেচারটি ঠিক কীভাবে গড়ে ওঠে? সে কি কবির কতকগুলি মুদ্রাগুণ? বাক্য ব্যবহারের নিয়মিত একটি বিশেষ প্রকার ? একই শব্দ একই আবহের পুনঃ পুনঃ নির্মিতি? হাতের তাসগুলো বারংবার দেখানো? তাকে কি তবে মুদ্রাদোষও বলা যেতে পারে? আর যে কবি সারা কবিতাজীবন নিজেকে পরীক্ষা করতে চান, বিপদে ফেলেন মুহূর্মুহূ, বই থেকে বই অন্তরে যার বাঁকবদল ঘটে, তার ক্ষেত্রে কী হবে সেই সিগনেচারের দ্যোতক? এমন কবি সুপ্রচুর না হলেও, কয়েকজন দিব্যি আছেন বই কি! তো, মনের মধ্যে এইসব এতোলবেতোল কূটতর্ক ওঠে। সিগনেচার আমাকে ভাবিয়ে তোলে  ভালোরকম

       ‘রেহেল এর পাঠানো এই লেখকনামহীন কবিতাগুলি পড়ে এইসব আপ্তবাক্য পুনরায় চিন্তাজলে বুড়বুড়ি কাটতে থাকল। তো, দ্বিতীয় তর্কে আগে আসি। 

       কবিতাগুচ্ছটি পড়ে আমি কবিকে চিনতে পেরে গেছি। নিশ্চিতভাবেই। যদিও কাব্যমালার কোথাও কোনো স্থাননাম কিংবা তেমন কোনও পরিচায়ক প্রপার নাউনের উপস্থিতি নেই, তবু। এখন, এটা কোনো গোয়েন্দা গল্প নয়, আর নামপ্রকাশ এই খেলার শর্ত নয়, তাই আমরা কবিকে কবিবলে ডাকবো। সুতরাং বলা যায় যে এই কবির একটি সুস্পষ্ট সিগনেচার আছে। শব্দ নিয়ে খেলাধুলো ইতিপূর্বে অনেকেই বাংলা কবিতায় করেছেন, কিন্তু এই কবির খেলা নিজস্ব আইনকানুনে তৈরি। তাই তিনি পূর্বের চেয়ে পৃথক। নীচে একটু কাটাছেঁড়ার প্রয়াস করা যাক। তবে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ এই যে, ক্রিকেটের সমস্ত ব্যকরণ আয়ত্তে আনলেই যেমন সচিন তেন্ডুলকর হওয়া যায় না, তেমনি এই সিগনেচারের খোঁজকে অনুসরণ করলেও কবির কাব্যরীতির এক্স ফ্যাকটরটি ধরে ফেলা সম্ভব হয়তো হবে না।

       শব্দজোড় তৈরি করে তাকে প্রায় নতুন শব্দে নতুন ঝংকারে বাজিয়ে নেওয়া এই কবির প্রিয় একটি কাজ। এই শব্দ তৈরি কবিরা হামেশাই করে থাকেন। আলোচ্য কবি সেটি চমৎকার মুনশিয়ানার সঙ্গে করেন এবং তার জোড় লাগানোগুলি অভূতপূর্ব বলে বোধ হতে থাকে। যেমন অঘটিতপূর্ব, ঝালচন্দ্রমা, আকাশগুঁড়ো, গন্ধভ্রূণ, দিগন্তফল, অনলনন্দিনী, কালোমঞ্জরী, কোকিলদরিয়া, ঝরাজ্বর, জিহ্বাসঙ্কুল, নিম্ননহবতখানা, বাক্যবিধুর, মুহূর্তগৃহ, জ্যোৎস্নাঘুঁষি।

       এই শব্দজোড় বা নতুন শব্দগুলি কোনোটা গুণবাচক বিশেষ্য আবার কোনও কোনওটা বিশেষণ পদ। তাতে কোনো আশ্চর্যের ব্যাপার নেই। এই কবির কবিকৃতির সঙ্গে পাঠকের অপরিচয় থাকলে কান আটকে যাবে ঝালচন্দ্রমাআর জ্যোৎস্নাঘুঁষিতে। এমন জোড় অসচরাচর। অথচ ধাক্কা সইয়ে নিলে ধরা যাবে, শুধুই শব্দমোহে তাদের জন্ম নয়। ইন্দ্রিয়গুলিকে আরেকটু রোমহর্ষক করে তুলতে পারলে একটা অনুভূতির ছবি ফুটে উঠতেই পারে। সাইনেস্থেসিয়ানামক বিরল-কিন্তু-থাকা-উচিত গুণ কিংবা অসুখ ভালো কবির তো থাকেই। এখন, কবি যদি শুধুই আমি কত দুর্দান্ত শব্দরচনা করতে পারি দ্যাখোবলে আসর মাতাতে নামতেন তবে তার কবিতার পুরোটাই মুহূর্মুহূ এইরকম উদাহরণে ছয়লাপ হয়ে থাকতো। তা হয়নি। উৎসর্গ কবিতাটি বাদ দিলেও ৯ টি পূর্ণাঙ্গের কবিতায় আমি ১৪ টা শব্দজোড় পেলাম। কবিতাপিছু হিসেবে সেটা সামান্যই। এই গুচ্ছের সবচেয়ে দীর্ঘ লেখা এমনি প্রেমের লেখা-৮এ কিন্তু শব্দজোড় প্রায় নেইই। কোকিলদরিয়া’, ‘নিম্ননহবতখানা’, মুহূর্তগৃহচমৎকার কাব্যকণা শরীরে ধারণ করে আছে। বিশেষত, শরীরের নিম্নাংশের জন্য নিম্ননহবতখানা উপমাটি কবির কল্পনাপ্রসারের ক্ষমতা দেখায়।

       এই কবিতাগুচ্ছের প্রধান গুণ এই যে, এত শব্দপ্রাচুর্যের মাঝেও বাক্যরীতি বা সিনট্যাক্স কিন্তু জটিলতার কুহকে হারিয়ে যায়নি। বরং এক সরলতা, এক শিশুমনের আঁচ পাওয়া যায়। শিশুমন? এও লেখকপরিচয়ের এক সূত্র বটে! শেষতক লেখাগুলো আসলে প্রেমের লেখাই। আকুতির ভাবটিও যাই যাই করেও পালায় না শেষ অবধি।

       উৎসর্গ কবিতায় একহাঁটু ঘুমের ভেতরএই বাক্যবন্ধ খুব আশ্চর্যরকমে আমাকে মনে পড়ায় কবেকার পড়া সমসময়ের অরূপরতন ঘোষের এক পঙক্তি একহাঁটু বিমানবন্দরকিন্তু এখানে প্রসঙ্গটি সম্পূর্ণ পৃথক। অরূপরতনের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন পঙক্তি রীতির থেকে আলোচ্য কবিটি ঢের দূরে।

       ‘এমনি প্রেমের লেখা-২তে কবি বহিরাঙ্গে ছন্দচাদর জড়িয়েছেন। এই কবিতাটা যেন খুব পুরনো সময় থেকে ভেসে আসতে থাকা পাঁচালির সুরের মতো একটা আবহ বুনে তোলে। অথচ এখানেও লেখকের মুদ্রাদোষ বা গুণ অটুট থেকেছে। নামের সঙ্গে গ্রামের, আমের, গ্রাম আর ঘাম, ঘর আর বর এইরকম পানিং এর আর্ষপ্রয়োগ এই কবিতায়- হয়তো বা ছন্দের কারণেই- সুপ্রযুক্ত ও সুমধুর ঠেকে। কিন্তু অন্যত্র কোথাও কোথাও মনে হয় এই পানিং একটা নিছক মোহের বশে করা। যখন ইহা ছাড়াও কবির ভান্ডারে আছে বিবিধ রতন।

       ‘খইয়ের চালের মতো বালির খোলায় তপ্ত তপ্ততর হয়ে শব্দ ফুটে ফুটে ফেটে যায়এই পঙক্তিতে কিন্তু ফধ্বনির বারংবার প্রয়োগ কিংবা তপ্ত শব্দের দুবার আসা অতিরেক নয়, বরং এক খোলার মধ্যে খই ফুটে ওঠার নৃত্যপর দৃশ্যশব্দটির সঠিক চিত্রায়ন করে তোলে। যিনি দেখেছেন, তিনি জানেন। 
চির আবেদনময় হৃদয়ভরপুর পঙক্তি যে এই কবি রচনা করতে পারেন  তার কিছু উদাহরণ এইবার নীচে

সেখানে কোথায় খসে গেছে নাকের ফুল, কানের শিশির

অসংখ্য স্নান খুলে নক্ষত্র তাকায় আকাশের রোমকূপ থেকে দেখো তুমি

যেন জলপ্রপাতের তলায় চোখ পেতে হেসে উঠছি দুজন

তোমার সিঁথির সরু পথে আমি এই মুহূর্তে রেখে দিলাম আমার চেরাগ

দাবীর পাশে পড়ে আছি, শান্ত দাওয়ার মতো

       এইরকম সদাজায়মান ভাষা যার আয়ত্তে আছে, তিনি কেন রজনীগন্ধা কে ভেঙে একটি রজনী নামিয়ে রাখি তোমার গন্ধেলিখবেন ? যা খুব সহজে ধরা যাচ্ছে। অনুভূতির প্রখরশীর্ষে নিজেকে তুলে আনতে পারলে হয়তো তোমার গন্ধের ভেতরে একটি রজনীর নতনম্র উপস্থিতি ধরতে পারা যায়। কিন্তু এই ভাঙার খেলা এক্ষেত্রে চোখ টেনে রাখে। এবং এই খেলা এই কবির সিগনেচাররূপে চিহ্নিত হয় বটে, কিন্তু সে সিগনেচার চুরি যাওয়া কিংবা ফটোকপি হওয়া খুবই সম্ভব। বরং আমার ভাবতে ভালো লাগে এই কবি শক্তিশালী এবং উপরোক্ত পঙক্তিমালাই তার আসল সিগনেচার।

·         খুব যদি ভুল না করি, বহুবছর আগে, কলেজ স্ট্রিটের কোনো এক বিকেলে, এই কবি, এই এতক্ষণের আলোচকের একটি তৎকালীন কবিতায় এরকম পানিং এর কৌশল পেয়ে বলেছিলেন, ‘লোভটা এড়িয়ে যেতে পারলি না?’ আমার এইসব মনে পড়ে যায় আর কী ! 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন