
কবির নাম, বয়স, লিঙ্গ, ঠিকানা ইত্যাদি যা কিছু কবিতার জন্য জরুরি নয়, তা আমরা মুছে দিয়েছি। আর এভাবেই ১০টি কবিতা পাঠানো হয়েছে অন্য এক কবির কাছে- আলোচনার জন্য। শুধু ১০টি কবিতা, আগে পরে নাথিং। আমাদের সাথে রুমালচুরির এই খেলা খেললেন ১৯ জন কবি।
এখানেও কবির নাম ছাড়া ১০টি কবিতা রাখা হল, সঙ্গে থাকলো আলোচনা। কবির নাম জানার রাস্তা কবিতার নীচ দিয়ে গেছে। তবে আমরা বলবো রুমালচুরির এই খেলায় আপনিও থাকুন। কবির নামটা না হয় একটু পরেই জানলেন।
১০টি কবিতা
১.
পৌঁছোনোর আগেই শুরু
হয়েছে তুষারপাত
আর সব জেনেও দামী নির্জনতা নিয়ে খেলা শুরু
করেছ
মাঝরাতের কাছাকাছি সময়
জানিনা আলকাতরার ডিবে নিয়ে আদৌ আলো অবধি
পৌঁছবে কিনা
যদিও দানাফসলের নামে ওয়ারেন্ট বেরিয়ে গেছে
যেভাবে পোড়া টোস্ট নিয়ে পাউডারের সাদা গুঁড়ো
গুঁড়ো কাঁধে
এখনও সমুদ্রের ধারের এক রোববারের
খোঁজ
সেভাবে উপকূল নরম মনে করার কোনো কারণ নেই
একটা ফোঁটা কেন !
বলার কথা পিঠ ভারী করা আনন্দ ফিরিয়ে আনতে
হবে…
যেন কী নিয়ে কথা বলছিলাম?
হ্যাঁ, একটা বোতামের মধ্যে বকুল গন্ধে নয়
বালির প্রথম ফাঁদটাতেই বর্ষা নেমে গেল
হর্ণ বাজাল কেউ
কয়েকবার
আর চুল ঠিক করে দাঁত মেঝে হাসিতে ভরে গেল
কারু মুখ
জানা গেল ওই ডুবে যাওয়া পা আর প্রতিশব্দের
পেছনে
কেটে যাওয়া আঙুল চুষতে চুষতে
এক হাঁড়ি নোঙর
আগলে ছুটে আসছে নীরব প্রজা…
২.
কিন্তু তা তো আর হয় না
বড় চামচের এক চামচ মেঘ মেশালেই মশারি গুটিয়ে
মনে করা যেত মাটির ঢিবি….
হয়ত রেললাইন ধরে কিছুটা এগিয়ে যেত রক্তচাপ
শবের লোভে আপনি শ্বাস কিনে খান
সাথে চাষবাস আর হাজার বছরের হুঁকো আর প্রসববেদনা
বাড়তি এই বাতাস
কাঁচকে ঠেলে কুটুমকে ঠেলে আস্ত কুমড়োর
বঁটিতে কথা পেড়েছে
আসলে বাতাস ঢুলু ঢুলু দুটো চোখ
ওখানে কেউ ঘুমায়না
জেগে আছ প্রমাণিত হওয়ার
পর
পই পই করে
পায়ে মোজা পরে শুতে বলে
পাছে ছুঁয়ে দেয় বর্ষায় গজিয়ে
ওঠা বোধহয়
কিন্তু তা তো আর হয় না
বাচ্চারা নড়লই না
স্ত্রীর হাঁপানি সারল না যেমন
কেবল ন্যাপথালিনের গুলি ছড়ানো হল
নতুন রাখালের চারধারে…..
৩.
কোঁচড়ে লুকিয়ে রাখা ডিম
আর ডিমের চোখ না ফোটা বাচ্চা
এই পরীক্ষা সাদা নার্সের পাশে
বসে থাকতে নিষেধ করে গেছে….
কোনও জাদুকর যখন দৃশ্যটিকে বেশ করে রপ্ত
করিয়েছেন
কোনও বাচ্চারা যখন মৃদু ঝাঁকুনিকেও উপেক্ষা
করতে শিখছে
তখনই প্রজাপতির দেহ থেকে প্রশ্ন উড়িয়ে দেওয়া
হল
তখনই হুইসেল দিতে দিতে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল
আকাশবাড়ির আলো…
বউ যে বাঁজা হল
খিদেয় যে কথা হল
ওজোনের গন্ধ ছাড়ল অসমাপ্ত উলুর শব্দে
জানিনা , ঘটকালি বাবদ শীলমোহর পেল কিনা
সিঁড়ি আর
শূন্যের মাঝে চোখে চোখ রাখা
চার পয়সার ছাদ…
৪.
আওয়াজে পা রাখা যাচ্ছে না
তেঁতুল কুড়োনো সেই হাসির আওয়াজ
কে বলবে কাদার গাঁথুনি থেকে মেয়েদের কোমর
থিতিয়ে এলে
কোটালের বাতাস লাগে
দু চার কথা পাহাড় জানে
জানে রিক্সা থেকে লাফ দিয়ে নামা সুন্দর
মলাটের ওই মানুষ
ঘোমটার ফাঁকে ফাঁকে ধরা কি পড়ে যাবে ঘাসের
কুটো?
তোবড়ানো মগ তাড়া করবে কমলা রঙের ছোড়দাকে?
আড়াল, এতবড় আড়াল
একটু হাওয়াতেই তো আলাপ
ভাঙ্গাচোরা মর্গের ভেতর ভক করে নাকে এসে
লাগা
বনের বাৎসরিক গন্ধ…
৫.
ভাত বাড়া শেষ ল্যাজ নাড়া শেষ
একটি বঁটি ও একটি বাটির দৃশ্য শেষ
দ্যাখো দরজা ভেঙে পড়ে আছে
শাপলার ডাঁটায় হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে স্বাভাবিক
মানুষ
আর আমি হেঁটে পেরোচ্ছি ঘরের মধ্যের নতুন খাট
এই বস্তি , আসলেই
ছোট্ট বিড়াল
একটু মাখামাখি হলেই ভাবে মাছের কথা
জানেনা মেঘ ঝুলে আছে কোথাও দু খানা…
হাস্যরসের ভেতর টুকরো টুকরো হয়ে কাশছে
হুলিয়া
আর ভাঙা আয়নায় হাতজোড় করে হাসি দাঁড়িয়ে…….
৬.
দোতলায় থাকি আমি
দুজন কাঠ মিস্ত্রী ঘুমোয় মাথায়
চোখ বন্ধ করেই তারা দুটো
তালা খুলে ফেলে…
যেন এ বাড়ির ছেলেকে পাহাড় চেনানো হবে
তার পাঞ্জাবীর বুক পকেটে ঈর্ষাতুর পায়রা
কুয়োর মতই কাঁদছে যার ভেতরটা…
আর এই কান্নার জন্যই কার্ণিশের দু এক লাইনও
ছিঁড়ে ফেলতে
কেটে ফেলতে পারছে না
আজ ভুল করে খোলা ছিল অই ধুনুরীর তুলো…
এখন এত এত
বিরোধের ভেতর বিছানা বালিশ
বুকে দুটো গুলির চিহ্ন নিয়ে রাতে থাকবে
কোথায় !
থাকবে কোথায় বলার মত বলা
হারিয়ে যাওয়া খড়মের বাউলি
সাজ, সাজো আজ পাতার শব্দের মত দাঁড়িয়ে
যেভাবে চাঁদ বাসি হলে
দুধেল গোরুর স্বপ্নদোষে
স্পষ্ট হয় একটু একটু করে দোতলা সিঁড়ি ধরার কথা….
৭.
স্তনের বোঁটা খুঁজে নিয়েছে যে পুরুষটি
আমি নিশ্চিত ওটুকু জায়গায় সে আঁটেনা
দুধের ভান করে যে দৌড়চ্ছে
আমি নিশ্চিত রোদে আর বাড়ি ফিরতে হবে না তাকে…
অর্থাৎ গলগল করে ঘেমে যাচ্ছে যখন আমাদের
সমুদ্রগামী বড় জাহাজ
তখনই বুকের ভেতর শেকড় বাকড় বেটে চলেছে বাঁধা
খাঁড়ি
কেন বলছ , এই জোরালো আলোয় অভাবই ছিল
একমাত্র আসবাব !
কেন বলছ, একটা ছোটো দূরবীন, যে আসছিল খুব দূর থেকে
যার ভেতর কোনো
দূর ছিল না
কিভাবে ধেনো বাতাস পেছনে লেগে থাকবে, সেটা নিয়ে
ভাবো
ভাবো, ঘাসের
পা দুটো বেরিয়ে আসছে বাইরে,
এরপর উঠোন
নিকোবে বলে………
৮.
গল্পটা শেষ হওয়ার মুখে…
ধরা যাক গল্পের এই অংশে একমাত্র আমিই মৃত
লিখতেই মনে পড়ে গেল সাদা বেড়ালের ঘুম
পাক খেতে খেতে কিভাবে পরিমান বাড়ল !
পাঁচিল থেকে লাফ দিয়ে নামল পশ্চিমের বাগান
আর আঁকশি দিয়ে টেনে নিল বাওড়ের রোদ
দৈর্ঘ্যপ্রস্থহীন এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে
স্রেফ ছায়ার লোভে আমি বড় হয়ে উঠছি
মানুষ আর মনখারাপের ভেতর ডুমো ডুমো করে কেটে
রাখছি অসংখ্য মথ
গল্পটা শেষ হওয়ার মুখে…
ধরা যাক গল্পের এই অংশে ইতিমধ্যেই কররেখা
থেকে
চুরি হয়েছে
একটি কাঁসার গ্লাস
আর হাতিশুঁড়ের পাতার নিচে কাদের হাততালি
ঘুমের জন্য হাত বাড়িয়েও ঢুলছে।
৯.
খিদেরও নাকি ঘাস হয়
যেমন ক্ষতের গায়ে মাটি ফেলা হয়
শিকারের কি চমৎকার অনুবাদ করছে শ্মশানের
গন্ধ
মনে হচ্ছে অপমৃত্যুর ভারী টানা দীর্ঘশ্বাস
আর তার ফ্রকের সাইজ আমার জানা নেই
অথচ মেয়েটি
উড়ছিল …
১০.
কাঁচ না থাকায় আরও বেশি করে কান্না পায়
মানুষের নাগালে থেকেও কেন কারও মনে হয় মাছেরা তাকে দেখছে?
শুধু নৌকো বানাতে এসে সারবছর ফুল দেয়
এমন কিছু গাছ
নেমে গেল
ভাবলাম ফুল মানে ফতোয়া
গুলি খেলা ছেড়ে যার ভেতর ছেলেরা গুজিমুজি
দিয়ে ঢুকে পড়ে
ওই যে বেড়াল, চোতের নতুন পাতার মত তিনটে
বাচ্চা পেড়ে
চলে গেল
আর খোকনের দুধ গরম করতে কি নির্ভুল দুটো ডুব
দিয়ে
ফিরে এল কেউ দীঘি থেকে
ফাঁকা বাস
বাসি রজনীগন্ধা
কাঁচ না থাকায় আরও বেশি করে কান্না পায়….
মাথার মধ্যে মেঘ
আলোচনা করলেন জহর সেন মজুমদার
লেখাগুলো পড়তে পড়তে একটা কথা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বাংলা কবিতা দীর্ঘকাল ধরে যে সযত্নে অভ্যস্ত-চৈতন্যে লালিত হচ্ছিল এবং পুরনো ভাষাকে নতুন ভাষা রূপে ব্যাবহার করবার কৃৎকৌশলটা প্রায় বাংলা কবিতা থেকে চলে যাচ্ছিল ক্রমশ এবং পঞ্চাশ দশক পর্যন্ত প্রায় বাংলা কবিতা একই ভাষায় কথা বলে এসেছে, একই শব্দ এবং একই চিত্রকল্প বার বার পৌনঃপৌনিক বাস্তবতার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে গেছিল এবং পঞ্চাশ এর দশক পর্যন্ত বাংলা কবিতা। সেই অর্থে পঞ্চাশ এর দশক পর্যন্ত বাংলা কবিতা খুব বড় রকমের ভাষা বদলের বা বাঁক বদলের দিকে যায়নি, এটা ব্যাক্তিগত আমার মত, ব্যাতিক্রমি কবি থাকতেই পারেন, উৎপল কুমার বসু কিংবা বিনয় মজুমদার কিংবা দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা প্রনবেন্দু দাশগুপ্ত কিংবা স্বদেশ সেন,
এরকম কিছু কিছু ব্যতিক্রমী পঞ্চাশ এর কবিরা রয়েছেন যারা ভাষাকেও এক অদ্ভূত প্রক্রিয়ায় ভাঙছিলেন এবং ভাষাকে চারপাশের ভাঙা সময়, ভাঙা বাস্তব এর সঙ্গে উপযুক্ত করে তুলছিলেন।
আমরা বুঝতেই পারছিলাম যে এই ভাষা খুব গোছানো এবং বিন্যস্ত ভাবধারা থেকে উঠে আসতে পারেনি। সবই যেখানে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে চারপাশে, ভাঙ্গনের শব্দ তো শোনা যায় না, ভাঙার দৃশ্য গুলো দেখা যায়,
ফলত একটা ভাষার ধ্বংসস্তুপ থেকে আবার নতুন করে আশা তৈরী করবার একটা প্রবণতা এই সময় দেখা গেলেও, ভাষা কে নতুন করে ঝাঁকুনি দেবার, একদম আমি ভেবে চিন্তে শব্দটা ব্যবহার করছি- ঝাঁকুনি দেয়া, এটা মূখ্যত আশির দশক থেকে শুরু হয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই যে বাংলা কবিতায় যে একটা ভাষা ক্রমশ নিদ্রিত, নির্জীব এবং সবচেয়ে বড় কথা ঝিম মরা ভাষায় পরিণত হয়েছিল, সেই ভাঙা সময়ে দাঁড়িয়ে বা ভাঙা ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে বা ভাঙা জীবনের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভাষা কে একেবারে নতুন করে গড়ে তুলবার মত অসাধ্য সাধনের কাজ আশি থেকে শুরু হল এবং আশির পর তো দেখাই যাচ্ছে যত দশক অনুযায়ী আমরা এগিয়ে যাচ্ছি ভাষা তত বদলে যাচ্ছে। নব্বই দশকের বড় একটা অংশ প্রতিষ্ঠানে থাকলেও বাদবাকি যে অংশটা অপ্রতিষ্ঠানের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে তারাও কিন্তু ভাষার আনুগত্যকে কখনও মেনে নেয়নি।
আমি বলব যে ভাষাটাকে সব প্রথমে আক্রমণ করা দরকার, তার কারণ হচ্ছে যে ভাষা থেকেই একটা অভ্যস্ত জীবনযাপনের পদ্ধতি তৈরি হয়ে যায়। প্রচলিত ভাষা, যে ভাষায় আমরা প্রতিদিন কথা বলি, সংযোগ স্থাপন করি এবং সেই ভাষা ব্যাবহার করতে করতে যে কখন ক্লিশে হয়ে যায়, ভাষার ওপর মলিনতার দাগ পড়ে যায় সেটা চট করে বাইরে থেকে বোঝা যায় না। সাধারণ পাঠক চায় যে ভাষা বহু ব্যাবহৃত সেই ভাষাতেই কবিতা লেখা হোক। ফলে একটা বড় অংশের কবিরা ভাষাকে কেন্দ্র করে সেই একই ভাবে বৈষ্ণবপদাবলি থেকে আজ পর্যন্ত একটা ছন্দে এবং লিরিকে চলে গেল। কিন্তু বাদবাকি একটা বৃহৎ অংশের জায়গা রয়ে গেল,
সমান্তরাল প্রকৃতির একটা ধারা রয়ে গেল যারা ভাষাকে, ভাষার নির্জীব এবং নিষ্ক্রিয়তা
থেকে আবার নতুন করে জাগিয়ে তুলবার একটা চেষ্টা করল।
এই কবিতা গুলো তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। যদি আমাদের কবিতা পাঠের প্রচলিত ধ্যানধারণা থেকে (কবিতা পাঠের তো একটা সত্যি ধারাবাহিক একটা দীর্ঘকালীন প্রসেস আছে, এ ব্যাপারটি নিশ্চয় অস্বীকার করবে না। দীর্ঘকাল ধরে আমাদের কবিতা পাঠের যে একটা প্রক্রিয়া ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়ায়) এই কবিতা গুলো পাঠ করা যাবে না। সেই প্রক্রিয়ায় এই কবিতা গুলো আবৃত্তি করা যাবে না। সেই প্রক্রিয়ায় কবিতাগুলোর একেবারে সরাসরি তীক্ষ এবং প্রত্যক্ষ মানে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। একেবারে, সরাসরি...
কোথাও যেন যে জীবন একটা মানে নিয়ে গড়ে ওঠে বা যে বাস্তব একটা মানের মধ্যে ক্রমাগত চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে কবিতাকে ক্রমশ একটা নির্দিষ্ট অভিমুখী গন্তব্যে পৌঁছে দিতে চায় সে ধরনের কবিতা কিন্তু আর এখন বিশেষ লেখা হচ্ছেনা, এবং আমি এক্ষেত্রে (যেহেতু নিজে আশি দশকের কবি) প্রথম এবং প্রাথমিক যে প্রাপ্য মর্যাদা এবং অংশীদার সেটা আশি কেই বলব। আশি দশকের অলোক বিশ্বাস, প্রনব পাল, রাহুল পুরকায়স্থ, বিজয় সিংহরা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এদের কবিতার ভাষা এবং চেতনা জগতটা বাংলা কবিতাকে বদলে দেওয়ার প্রাথমিক চেষ্টা করেছিল। যেটার একটা সার্থক উদাহরণ বা প্রতিফলন হল এই কবিতা গুলো।
এটা সত্যি যে আমরা দুই ধরনের বাস্তব দেখি এক হল সারফেস রিয়ালিটি, আর একটি হচ্ছে ইনার রিয়ালিটি। এখন সারফেস রিয়ালিটি কি? একেবারে বাইরের প্রত্যক্ষ বাস্তব, দিনানুদৈনিকের বাস্তব, যে বাস্তব চোখে দেখা যায়, যে বাস্তবের সঙ্গে সরাসরি একটা সংযোগ তৈরি করা যায়। সচরাচর হয় কি আমরা এই সারফেস রিয়ালিটিতে থাকতে বেশি পছন্দ করি, সাধারণ যারা মানুষ, তাদের কাছে সারফেস রিয়ালিটির কোনো বিকল্প বা গত্যন্তর নেই। তারা এর মধ্যেই থাকে। কিন্তু সারফেস রিয়ালিটির বাইরে যে ইনার রিয়ালিটি, কবিদের কাজ সেই ইনার রিয়ালিটির কারুকাজ। ইনার রিয়ালিটির এই সন্ধান কিন্তু একমাত্র লেখক কবিরাই করতে পারে। এই ইনার রিয়ালিটির কারুকাজটা, কোনো সন্দেহ নেই, এসেছে বাংলা কবিতায় তিরিশ দশকের জীবনানন্দ থেকে। আর ইনার রিয়ালিটি থেকে একটা ইনার সাইকোলজির জায়গা তৈরি করে দিচ্ছে এই সব কবিতা গুলি।
আমি জানিনা এখনও পর্যন্ত এই কবিতা গুলি কে লিখেছেন? জানার দরকার ও নেই। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখুন এগুলো এই যে পংক্তিগুলি আমি পড়ে যাচ্ছি এই পংক্তিগুলি একটাও আমাদের সারফেস রিয়ালিটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় না বরং সারফেস রিয়ালিটিকে আস্তে আস্তে আরও অপরিচিত আরও রহস্যময় আরও ঘনীভূত সংকটের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়।
লক্ষ্য করে দেখ এই যে যে লাইন গুলো আমি বলতে চাইছি "বড় চামচের এক চামচ মেঘ”, “এক হাঁড়ি নোঙর” বা “বাতাস ঢুলু ঢুলু দুটি চোখ” কিংবা “ডিমের চোখ না ফোটা বাচ্চা” কিংবা “প্রজাপতির দেহ থেকে প্রশ্ন উড়িয়ে দেওয়া হল” কিংবা লক্ষ্য করে দেখ “ভাঙ্গাচোরা মর্গের ভেতর থেকে ভক করে নাকে এসে লাগা বনের বাৎসরিক গন্ধ” কিংবা “এই বস্তি আসলেই ছোট্ট বিড়াল” এই যে অনুষঙ্গগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে, এই অনুষঙ্গগুলি একটাও সারফেস রিয়ালিটির সঙ্গে সম্মুখ ভাবে সংযুক্ত নয়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, এটা কবিরাই দেখতে পান, এই দৃশ্য গুলো পরম্পরাগতভাবে সারফেস রিয়ালিটির মধ্যেই রয়েছে। সারফেস রিয়ালিটির দৃশ্য গুলি কে ইনার রিয়ালিটি এবং ইনার রিয়ালিটি থেকে ইনার সাইকোলজিতে পৌঁছে দিচ্ছে এই পংক্তিগুলি।
সত্যি বলতে বাস্তবিক অর্থে “এক হাঁড়ি নোঙর” বললে সারফেস যে রিয়ালিটি, সে রিয়ালিটির কাছে একটা বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ যে বাস্তবতা সেই সাধারণ বাস্তবতা থেকে প্রশ্ন উঠে আসবে
"এক হাঁড়ি নোঙর" মানে? এক হাঁড়ি ভাত হয়, এক হাঁড়ি চাল হয়, কিন্তু এক হাঁড়ি নোঙর হয়না। ফলে সারফেস রিয়ালিটি এখানে কিন্তু এই পংক্তির কাছে এসে হাঁটু গেঁড়ে ভেঙে পড়বে, অপদস্ত হবে, বিপর্যস্ত হবে। সারফেস রিয়ালিটি এর মানে খুঁজতে শুরু করবে। "এক হাঁড়ি নোঙর " বলতে কি বলা হচ্ছে? কিংবা "বড় চামচের এক চামচ মেঘ"। এক চামচ মেঘ আমরা কল্পনা করতে পারিনা। এক চামচ মধু হতে পারে, এক চামচ চিনি হতে পারে, এক চামচ চা হতে পারে। কিন্তু এক চামচ মেঘ! সারফেস রিয়ালিটি একে গ্রাহ্যতা দেবেনা, মান্যতা দেবেনা, কারণ এই পংক্তি গুলো, এই চিত্রকল্পনা গুলো আসলে সারফেস রিয়ালিটির ভেতর থেকে প্রতিদিনের দিনানুদৈনিক যে গুলোকে আশ্লেষে এবং সংশ্লেষে ব্যাবহার করে চলেছি তাকে নতুন রূপে, নতুন চেতনায় পৌঁছে দেবার যে এই ইনার জগতটা তৈরি করা হচ্ছে, এই পুরো ইনার জগত টা একটা বড় প্রশ্নচিহ্ন সারফেস রিয়ালিটির কাছে।
সারফেস রিয়ালিটি কোনো দিন এই ইনার রিয়ালিটি বা ইনার সাইকোলজিকে বুঝতে চায়নি, সমর্থনও করেনি। বুঝতে চায়নি এই কারণে য্ সারফেস রিয়ালিটির সত্যি বলতে ক্ষমতাই নেই এগুলো বোঝার। আর সমর্থন করেনি এই কারণে যে, যদি এই গুলো কে সমর্থন করে তাহলে সারফেস রিয়ালিটির আহার নিদ্রা মৈথুনের ত্রুটিগুলো, যে চার দেওয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে আছে তার ভরাডুবি ঘটে যাবে। ভাঙা জাহাজের মত সারফেস রিয়ালিটি ডুবে যাবে। সুতরাং সারফেস রিয়ালিটি একে মানবেনা, গ্ৰহণ করবেনা, বর্জন করতে চাইবে। প্রতিনিয়ত একে বর্জন করতে চাইবে, যে- না এর মধ্যে কোনও প্রকৃত অর্থ, কোনও বাস্তব নেই; এর মধ্যে কোনো জীবন নেই,
এর মধ্যে কোনো ভাবনা নেই,
এর মধ্যে কোনো ব্যাঞ্জনা নেই।
বাতাসের অনেক কিছু হয়, বাতাসের দুটি ঢুলু ঢুলু চোখ...
ভাবা যায়?
কোথাও একটা সম্ভাব্য বাস্তবতা অতিক্রম করে একটা অসম্ভাব্য বাস্তবতার দিকে এই কবিতা গুলো নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। কিন্তু তার মানে এই না যে এই অসম্ভাব্য বাস্তবতা, সম্ভাব্য বাস্তবতার কোথাও নেই, আছে। শুধু আমরা সাদা চোখে, খালি চোখে দেখতে পাইনা। আর সচরাচর হয় কি, যা আমরা দেখতে পাইনা সেগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে আমাদের সংশয় তৈরি হয়। যদিও এই সংশয়টা ঈশ্বর সমন্ধে অনেক সময় হয়না। যে ঈশ্বর কে দেখতে পায়না অথচ আমরা কিন্তু ঈশ্বর কে মেনে নিই। কিন্তু এই যে না দেখতে পাওয়া দৃশ্য গুলি,
চিত্রকল্পনা এই গুলো কিন্তু মেনে নেবনা। কিংবা ডিমের চোখ না ফোটা বাচ্চা- ভয়ঙ্কর চিত্রকল্পনা। লক্ষ্যণীয় বিষয় আমি একবারও চিত্রকল্প বলছিনা, সেটাই আমি পরে আসছি কেন বলছিনা। কিংবা এই যে প্রজাপতির দেহ থেকে প্রশ্ন উড়িয়ে দেওয়া হল, আমরা প্রত্যেকে সমাজ বাস্তবতা কিংবা স্বাভাবিক বাস্তবতায় যারা প্রতিনিয়ত জড়িয়ে আছি,
তারা প্রজাপতির দেহ থেকে যে কোনো প্রশ্ন উত্থিত হতে পারেনা সেই স্বাভাবিকতা এবং সেই বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই দীর্ঘকাল ধরে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এগিয়ে চলেছি। কিন্তু এর একটা ভয়াবহ অন্তর্গত এবং বিপদজনক বিশ্বাস যোগ্যতা রয়েছে।
এই গোটা কবিতা পাঠের পর, দশটা কবিতার মধ্যে থেকে একটা অদ্ভুত জীবন উঠে আসছে। এই লেখা গুলো পড়তে পড়তে আমার দুজনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তার মানে এই নয় যে তাদের সঙ্গে সাদৃশ্যবাচক। একটা হচ্ছে একটা কবিতা, কবিতাটা লিখেছিলেন টেড হিউজ, অসামান্য কবিতা। টেড হিউজের কবিতাটার নাম ছিল থট ফক্স, তিনি বলছেন এরকম,
যে সন্ধ্যাবেলা হয়ে গেছে, অন্ধকার নেমে আসছে এই সময় একটা সাদা কাগজ নিয়ে তিনি কবিতা লিখতে বসেছেন। তা কবিতা লিখতে বসে যখন সাদা কাগজের দিকে ঝুঁকে আসছেন তখন তার মনে হচ্ছে মাথার মধ্যে এক ঘন কালো জঙ্গল তৈরি হয়ে গেল। এবং টেড হিউজ বলছেন কবিতার মধ্যেই যে, হঠাৎ সেই জঙ্গলের মধ্যে, মাথার ভেতর কালো জঙ্গলের মধ্যে একটা শেয়াল ঢুকে পড়ল। আবার দেখ স্বাভাবিক বাস্তবতা বা যেটাকে আমরা সারফেস রিয়ালিটি বলি, তার সঙ্গে কিন্তু আদৌ গ্ৰাহ্যতা বা মান্যতা পাচ্ছে না এই দৃশ্য। কোথাও যেন স্বাভাবিক বাস্তবতা আক্রান্ত হচ্ছে, এই দৃশ্য দ্বারা। শেয়ালটা ঢুকে গেল এবং তারপর ঘোরের মধ্যে তিনি লিখছেন এবং লেখবার পর যখন কবিতা লেখাটা শেষ হল- টেড হিউজ স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন যে এবার শেয়ালটা মাথার ভেতর থেকে নিষ্ক্রান্ত হল। এক্ষেত্রে আমি কিন্তু অন্য একটা কথা বলব,
এই কবিতা গুলো মানে আমাদের যে পাঠ্য কবি আরকি, পাঠ্য বলব না অপাঠ্য বলব,
স্বাভাবিক বাস্তবতার কাছে সম্পূর্ণ অপাঠ্য কবিতা কেননা যেখানে এখনও ছন্দে এবং লিরিকে বার বার কথা বলা হয় যেখানে সরাসরি প্রত্যক্ষভাবে একটা রাজনৈতিক স্লোগানকেই কবিতা করে তোলা হয় বা একেবারে সাদা-মাটা ভাবে সাধারণ বিবরণ বা বর্ণনাকেই যেখানে কবিতা বলে এখনও চালিয়ে দেওয়া হয় এবং দীর্ঘদিন ধরে আমরা লক্ষ্য করছি এক জাতীয় ছড়াকেও বাংলা কবিতা বলা হচ্ছে। এমনকি সাম্প্রতিক যে বাংলা গান,
ব্যান্ডের গান সেগুলো, অনেক কবিকে দেখছি সেরকম লিখতে চেষ্টা করছেন, তারা ভাবছেন যে বাংলা ব্যান্ডের গান গুলোই হচ্ছে কবিতা। ফলে বাংলা কবিতা ক্রমশ আবার নতুন করে দেখছিলাম কিছু দিন ধরে দেখছিলাম ছড়ার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে, বাংলা ব্যান্ডের গানের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। কিন্তু এই কবিতা গুলো আশা এবং আস্থা যোগাল যে বাংলা কবিতা আবার বেরিয়ে আসতে চাইছে নতুন কোন জীবনযাপন বা উজ্জীবনের দিকে। কিন্তু এই কবিতার কথায় আমি টেড হিউজের কবিতাটার কথা বলছিলাম এই কারণে- এই যে কবি লিখছেন তার মাথার মধ্যেও এরকম একটা শেয়াল ঢুকে গেল,
কিন্তু শেয়ালটা বেরোয়নি। হিউজের সঙ্গে ডিফারেন্স হচ্ছে এই কবিতা গুলো তোমরা পড়লে দেখতে পাবে, হিউজ বলছেন শেয়ালটা ঢুকে গেল, হিউজ লিখলেন আবার শেয়ালটা বেরিয়ে গেল কবিতা লেখা সম্পূর্ণ হয়ে গেল। এই কবিতা গুলো কিন্তু তা বলছেনা। এই কবির মাথায়ও কোনো এক শেয়াল বা কোনো এক প্রজাপতি বা কোনো এক ঢুলু ঢুলু চোখ সর্বোচ্চ বাতাস কিংবা এক চামচ মেঘ ঢুকে পড়ছে। তারা কিন্তু আর বেরিয়ে আসছে না। তারা রয়ে যাচ্ছে মাথার ভেতর। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি টেড হিউজ শেয়ালের থেকে মুক্তি পেয়েছেন কিন্তু এই কবির পক্ষে ঐ এক চামচ মেঘের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া কিংবা ঐ বাতাসের ঢুলু ঢুলু চোখ থেকে মুক্তি পাওয়া বা ডিমের চোখ না ফোটা বাচ্চাদের থেকে মুক্তি পাওয়া কিংবা একেবারে প্রশ্নকন্টকিত প্রজাপতির হাত থেকে মুক্তি পাওয়া, নিষ্কৃতি পাওয়া এত সহজ নয়। কারণ এরা ঢুকছে আর বেরোচ্ছে না । টেড হিউজ একটা প্রবেশ এবং প্রস্থানের জগত তৈরি করেছেন। এখানে কিন্তু শুধু প্রবেশ আছে, প্রস্থান নেই। এইটা গুরুত্বপূর্ণ এবং আমিও ব্যক্তিগত ভাবে এই পন্থায় বিশ্বাস করি। শেয়াল ঢুকবে শেয়াল থাকবে মাথার ভেতরে, সে বেরিয়ে আসবেনা। যতক্ষণ পর্যন্ত শেয়াল মাথার মধ্যে থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত প্রজাপতি মাথার মধ্যে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত বোলতা মৌমাছি বা ভিমরুলরা মাথার মধ্যে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত একজন মানুষ তার চারপাশের গতানুগতিক সারফেস রিয়ালিটির সঙ্গে অনিবার্য সংঘাত তৈরি করতে পারবে। এবং যতক্ষণ পর্যন্ত এই অনিবার্য সংঘাতের জায়গাটা থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত কবিতাটা কবিতাই থাকবে, ছড়া হবেনা, গান হবেনা। এটা গেল টেড হিউজের প্রসঙ্গ।
দ্বিতীয়ত এই কবিতা গুলো পড়তে পড়তে আমার এক অসামান্য নাটকের কথা মনে পড়ছে সেটা হচ্ছে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের
“মৃত্যু সংবাদ”। “মৃত্যু সংবাদে” স্বাভাবিক বাস্তবতা বা সারফেস রিয়ালিটির সঙ্গে সংযুক্ত কতকগুলো চরিত্র রয়েছে। বুলা, সুবোধ, নিরেনবাবু এরকম কিছু চরিত্র আছে সারফেস ভ্যালুর সঙ্গে যুক্ত। এই সারফেস ভ্যালুর মধ্যে হঠাৎ একটা আগন্তুক চরিত্র ঢুকে পড়ল। নাম না জানা চরিত্র। সে একটা জঙ্গলের মধ্যে পড়ে ছিল, সুবোধ তাকে প্রথম দেখতে পায়। বুঝতে পারছেনা যে ওই আগন্তুক মানুষটা মৃত না জীবিত, তারপর দেখা গেল সে জীবিত এবং তাকে ঐ বুলা যে ঘরে থাকে সেই ঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। বুলাদের একটি নাট্যগোষ্ঠী আছে, তারা নাটক ইত্যাদি করে এবং সামনেই স্পোর্টস সেই স্পোর্টসের আয়োজন চলছে সেই সময়। সুবোধের হাত ধরে আগন্তুক মানুষটি সারফেস রিয়ালিটির মধ্যে ঢুকে পড়ল। এবং নাটক থেকেই আমরা জানতে পারছি যে সুবোধ এবং বুলার মধ্যে একটা সম্পর্ক রয়েছে এবং তারা পারস্পরিক বিবাহ বন্ধনেও আবদ্ধ। অর্থাৎ সারফেস ভ্যালু প্রস্তুত, পারস্পরিক বিবাহ বন্ধন পর্যন্তও প্রস্তুত। ঠিক তার মধ্যে মোহিত চট্টোপাধ্যায় অসামান্য কৌশলে আগন্তুক চরিত্রটিকে নিয়ে এলেন। এবং সে এই সারফেস রিয়ালিটির জগতটাকে পুরো ঝাঁকুনি দিয়ে গেল। আমাদের সারফেস ভ্যালুর মধ্যে যে আনুগত্যের জীবন, পোষ মানার জীবন,
আপোসের জীবন,
পাপোষের জীবন সেগুলো ভাঙ্গতে শুরু করে এই আগন্তুক মানুষটি। সে বলে যে আমার মাথার মধ্যে একটি প্রজাপতি ছিল, এই মাত্র দেখোনা এই উড়ে তোমার গায়ে গিয়ে বসেছে, আবার আমার মাথার মধ্যে একটা ভীমরুল ঢুকে পড়েছে। অদ্ভুত একটা আগন্তুক মানুষ, বলছে আমার মাথার মধ্যে একটা ভীমরুল ঢুকে পড়েছে আর দেখো আমার মাথা থেকে প্রজাপতিটা বেরিয়ে গেছে। লক্ষ্য করে দেখো যে যেদিন থেকে ভীমরুলটা ঢুকে পড়েছে সেদিন থেকে সে অতীষ্ট হয়ে উঠেছে।
সচরাচর আমরা আমাদের অনুগত জীবনের প্রজাপতিটাকে প্রাণপনে লালন পালন করতে থাকি, করতে চাই। ভীমরুল মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ুক, শেয়াল মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ুক, এক চামচ মেঘ মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ুক এটা আমাদের অনুগত জীবন চায়না। ফলে কোথাও একটা আগন্তুক প্রয়োজন। যতক্ষণ না পর্যন্ত এই নাট্যগোষ্ঠীর মধ্যে, বুলা এবং সুবোধের জীবনের মধ্যে আগন্তুক ঢুকে পড়ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সারফেস রিয়ালিটির জগতটা বদলাচ্ছে না । আগন্তুক গোটা জায়গাটাকে একেবারে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। অর্থাৎ প্রত্যেকে যেভাবে আমাদের স্বাভাবিক জীবচৈতন্য এবং জীবনচৈতন্যকে আশ্রয় করে যেভাবে জীবন দেখে, বাস্তব দেখে এবং একটা আমুদে এবং আহ্লাদে যেটা জীবনানন্দ বলছেন শূকর এবং শূকরীর উৎসবে মত্ত থাকে- সেই জায়গটা ভাঙ্গতে শুরু করে আগন্তুক। এই নাটকটা আমার যতদূর মনে পড়ছে ১৯৬৫ সালে। তারপরও অদ্ভুত মোহিত চট্টোপাধ্যায়, (আমি এই কারণে এত গুরুত্ব দিচ্ছি, যারা কবিতা লিখতে আসেন তারা পড়লেও হয়তো উপকৃত হবেন) একটা নাটকের নাম দিচ্ছেন “গন্ধরাজের হাততালি”। এই নামের মধ্যে গোটা প্রক্রিয়াটা লুকিয়ে আছে। আমরা সবাই গন্ধরাজকে তার স্বাভাবিক বাস্তবতা প্রেক্ষিত থেকে দেখি। আমরা গন্ধরাজ বললেই তার সাদা স্বাভাবিক অবস্থানগত বাস্তবতা বুঝতে পারি। ফুটে ওঠা ফুল। কিন্তু গন্ধরাজের হাততালি আমরা চট করে স্বাভাবিক বাস্তবে কেউ শুনতে পাইনা। দূর্ভাগ্য আমাদের বলতে হবে যে কত বছর আগে মোহিত চট্টোপাধ্যায় যখন এসব নাটক লিখছেন, বা বাদল সরকার যখন নাটক লিখছেন, যে নাটক গুলোকে অনেকে পরবর্তী কালে আ্যবসার্ড নাটক বলে চিহ্নিত করেছে। বলেছে এগুলো উদ্ভট নাটক; আসলে তো উদ্ভট নাটক নয়,
আ্যবসার্ড নাটক নয়। বাস্তবের অন্তর্গত, বাস্তবের অন্তর্ভুক্ত আর একটা সমান্তরাল বাস্তবের কথাই বলা হচ্ছে। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ভাবে দুটো বাস্তবের একটা ব্যবচ্ছেদ ঘটে যাচ্ছে। একটা বাস্তব, যে বাস্তব আমাদের চোখে দেখা বাস্তব, যে বাস্তবের সঙ্গে আমাদের প্রতিনিয়ত ঘর করতে হয়, সহবাস এবং সংসর্গ করতে হয় সেই বাস্তব। আর একটা বাস্তব, যে বাস্তব আমাদের ভেতরে রয়েছে, একেবারে পরিষ্কার সেই ভেতরের বাস্তবটা। যেখানে আমরা শুধু স্বপ্ন দেখিনা সেই সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নের ধ্বংসস্তুপও আমরা দেখতে পাই । যেখানে প্রতিনিয়ত একটা প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির অনিবার্য দ্বন্দ্ব ক্রমাগত চলছে। যদি ১৯৬৫ সালে মোহিত চট্টোপাধ্যায় পরিচিত বাস্তবকে বিভিন্ন অনুষঙ্গ দিয়ে অপরিচিত করে তোলবার দুঃসাহস দেখাতে পারেন, তারপরও কেন বাংলা কবিতা এই দুঃসাহসের দিকে যাবেনা? আমার ভালো লাগছে যে এই কবিতা গুলো সেই দুঃসাহসকে আবাহন করে আনছে।
তুমি-আমি যে বাস্তবের মধ্যে রয়েছ বা আছি সে বাস্তব অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা বাস্তব। আমার সত্যি বলতে, আলো অন্ধকার নিয়ে প্রশ্নে এখন মনে হয়- আলো একটা প্রতারণা মাত্র, আমরা জন্ম থেকে শুনে আসছি যে আমরা অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাব,
কেন? মিথ্যে কথা, একেবারে। আলো বলে কিছু হয়না, অন্ধকারটাই সত্যি। কেন আমরা এটা বলতে পারছিনা যে আমরা আলো থেকে অন্ধকারে যাব। ফলত কি হয়েছে, আমাদের কবিতায় সেই জন্যই (এমনকি দেখেছি যেসব কবিরা বাঁকবদল করেন সেইসব কবিতার শেষে শেষ পর্যন্ত) সেই আলোর কাছে পৌঁছাবার একটা আকুতি থেকে যায়। কেন?
কেন উল্টো ভাবে আমরা ভাবছিনা? যে আলো থেকে অন্ধকারে পৌঁছে যাওয়াটাই হচ্ছে আমাদের জীবনযাপনের একমাত্র গন্তব্য হতে পারে।
অন্ধকারের মধ্যেই সৃষ্টির, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মান্ডের সার এবং সারাৎসার রয়ে গেছে। যেসব মিথোলজি গুলো আমরা পড়ি, সৃষ্টির উৎসের কথা যেখানে বলা হচ্ছে, বাইবেলে বা আমাদের ভারতীয় বিভিন্ন পুরাণে, সেখানে দেখবে যে বলা হচ্ছে যে সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকে, সৃষ্টির সঙ্গে তিনটি অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে। একটা হচ্ছে সাইলেন্স বা স্তব্ধতা, একটা হচ্ছে ওয়াটার বা জল,
আর একটা হচ্ছে ডার্কনেস বা অন্ধকার। লক্ষ্য করে দেখ,
অথচ আমরা প্রাণপনে অন্ধকার থেকে আলোয় যাওয়ার চেষ্টা করছি। আমি অবশ্য নিজে ব্যাক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি যে সৃষ্টির সূচনা লগ্নে এই তিনটির সঙ্গে আর একটা ছিল,
সেটা অবশ্য তারা কেউই বললেন না, কেন সেটা আমার কাছে বিস্ময় যে পুরাণে বলা হচ্ছে স্তব্ধতা, জল এবং অন্ধকারই ছিল সূচনা লগ্নের তিনটি প্রধান উপাদান। চতুর্থ উপাদানও আছে, তা হল যৌনতা বা সেক্স। সেটা ধরা হল না। লক্ষ্য করে দেখো,
সেটা ছাড়া তো হতে পারেনা। মানে আমরা স্তব্ধতা থেকে,
জল থেকে এবং অন্ধকার থেকে সৃষ্টিকে তুলে আনছি বা সৃষ্টি কে বহন করছি। সুতরাং অন্ধকার থেকেই আমাদের যখন বহন করা শুরু হয়েছে তাহলে আমরা অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাব কেন?
আলো হয়তো আংশিক সত্য, অন্ধকারও সেই রকম সত্য আমাদের জীবনে। এবং আমার কাছে আলোর থেকে অন্ধকারকে অনেক বেশি আপন আত্মীয় মনে হয়। আবার মজার ব্যাপার হচ্ছে যে মানুষটা সারাদিন আলো আলো করে গেল সে রাত্রের সময় সুইচ নিভিয়ে ঘর কিন্তু অন্ধকার করেই শোবে। তাহলে কোথাও একটা আমাদের অভ্যন্তরে অন্ধকার রয়ে গেছে, যে অন্ধকারটা আমরা চাই। তাহলে এরকম হলনা কেন যদি আমরা সত্যি আলো ভালোবাসতাম তাহলে রাত্রে শোয়ার আগে নিজেরাই সুইচ বোর্ডের কাছে সুইচ টিপে অন্ধকার করে দিচ্ছি কেন?
ঘর অন্ধকার করে দিতে ভালোবাসছি কেন? তার মানে কোথাও আমাদের ভেতরে একটা অন্ধকার রয়েছে। আসলে যতদিন যাচ্ছে ক্রমশ বুঝতে পারছি আমরা যে আমরা একটা ক্রমশ অর্থহীনতার মধ্যে চলে যাচ্ছি। এবং একটা সমস্ত জীবনের মধ্যে সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকে একটা তামসিক অভিব্যাক্তির মধ্য দিয়ে আমাদের সংক্রমণ ঘটে যাচ্ছে দিনের পর দিন। এই কবিতা গুলো আমাদের যে অভ্যস্ত জীবন, অভ্যস্ত চৈতন্য, আমরা যে জীবন দীর্ঘদিন ধরে পালন করে আসছি সেই জীবনটাকে নতুন করে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।
মানুষের যে দুটি সত্তা একটা সারফেস রিয়ালিটির সত্তা, সেই সারফেস রিয়ালিটির সত্তা সবসময় ছন্দোবদ্ধ। আর ইনার রিয়ালিটির সত্তা সবসময় ছন্নছাড়া। দীর্ঘকাল বাংলা কবিতা বারবার সারফেস রিয়ালিটির ছন্দোবদ্ধ সত্তাটার পরিচয় দিয়েছে। আনুপূর্বিক বিবরণ দিয়েছে। কিন্তু ইনার রিয়ালিটি বা ইনার সাইকলজির সঙ্গে যুক্ত যে ছন্নছাড়া সত্তা, যে জীবন প্রতিনিয়ত আমাদের চোখের সামনে ভেঙে পড়ে, যে বাস্তব প্রতিনিয়ত মুহূর্তে মুহূর্তে আমাদের চোখের সামনে রঙ বদলায়, সেই বাস্তবটাকে চিনিয়ে দেবার দায় এবং সময় কবিদের সম্ভবত এসে গেছে এবং এসে গেছে বলছি কেন একেবারে শুরুও হয়ে গেছে। কারণ আশি এবং আশি পরবর্তী বাংলা কবিতার প্রবণতা, মূল প্রবণতা সেই দিকে চলেছে।
এখানে অসামান্য দক্ষতায়, একটা বস্তি তাকে বিড়ালের চিত্রকল্পনায় ধরা হচ্ছে। "এই বস্তি আসলেই ছোট্ট বিড়াল একটু মাখামাখি হলেই ভাবে মাছের কথা"। অসামান্য পংক্তি। আর একটা জায়গা খুবই ভালো লেগেছে সেটা হচ্ছে "আলকাতরার ডিবে নিয়ে আদৌ আলো অব্দি পৌঁছবে কিনা"- সত্যি তো আমাদের পুরো ভেতরটাই আলকাতরার ডিবে হয়ে আছে। কিন্তু আমাদের ভুল জায়গা হচ্ছে আমাদের আলোর কাছে পৌঁছতেই হবে এই দায়, এই দিব্যি, এই আনুগত্য। এমনও হতে পারে আলকাতরার ডিবে নিয়ে আমরা আলোর কাছে পৌঁছতে চাইছিনা, অন্ধকারের কাছে পৌঁছতে চাইছি, সেটা হতে পারে এবং সেটা হওয়াই বাঞ্ছনীয় এবং আমি ব্যাক্তিগত ভাবে সেটাই কামনা করি।
সত্যি বলতে আমাদের (দীর্ঘদিন ধরে) নোঙর বললেই জাহাজের কথা,
নোঙর বললেই সমুদ্রের কথা মনে পড়ে যায়। এক হাঁড়ি নোঙর বললে কিন্তু এই ব্যাপারটা থাকছেনা। এই একটা অদ্ভুত চিত্রকল্পনা, আমি আবার বলছি চিত্রকল্পনা, চিত্রকল্প নয় কারণ আমি অনেক বেশি গুরুত্ব দিয় চিত্রকল্পনাকে চিত্রকল্পের থেকে। এই ডিমের চোখ না ফোটা বাচ্চার কথা বলতে বলতে যে জায়গাটায় আমি পৌঁছাতে চাইছি, তা কবিতার বা কবিতাগুলির কেন্দ্রীয় ভাবকল্প। যদিও এই সমস্ত কবিতা দশটি অংশে বিভক্ত কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এগুলি টানা এক ধারাবাহিক প্রবহমান কবিতা, যেখানে প্রত্যেকটি কবিতার একের সঙ্গে অপরের গভীর সম্বন্ধ রয়েছে।
এই কবিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জায়গা থেকে আমরা এই কবিতাটার মধ্যে সহজে স্বচ্ছন্দ্যে (যদিও এই কবিতায় একটাও সহজ সাচ্ছন্দ্যের প্রবেশপথ নেই, তবু বলছি যে আমরা যারা নতুন কবিতা, নতুন চেতনার নতুন বাস্তবতার অভিমুখী হতে চাই,
তারা যে জায়গা থেকে এই কবিতার মধ্যে) ঢুকতে পারি (বা ঢোকার সম্ভাবনা রয়েছে) সেটা হচ্ছে ভাঙাচোরা মর্গের ভেতর ভক করে নাকে এসে লাগা বনের বাৎসরিক গন্ধ। একটা বন সে মর্গের ভেতর থাকে না আমরা জানি, মর্গের ভেতর কারা থাকে কিভাবে থাকে তাও জানি, মর্গের গন্ধ কিরকম তাও আমরা জানি। একটা বন সে মর্গের ভেতর বন্দী হয়ে আছে। এই কবিতা মর্গ থেকে একটা আস্ত সবুজ বনকে বাইরে বের করে আনবারই কবিতা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন