
কবির নাম, বয়স, লিঙ্গ, ঠিকানা ইত্যাদি যা কিছু কবিতার জন্য জরুরি নয়, তা আমরা মুছে দিয়েছি। আর এভাবেই ১০টি কবিতা পাঠানো হয়েছে অন্য এক কবির কাছে- আলোচনার জন্য। শুধু ১০টি কবিতা, আগে পরে নাথিং। আমাদের সাথে রুমালচুরির এই খেলা খেললেন ১৯ জন কবি।
এখানেও কবির নাম ছাড়া ১০টি কবিতা রাখা হল, সঙ্গে থাকলো আলোচনা। কবির নাম জানার রাস্তা কবিতার নীচ দিয়ে গেছে। তবে আমরা বলবো রুমালচুরির এই খেলায় আপনিও থাকুন। কবির নামটা না হয় একটু পরেই জানলেন।
১০টি কবিতা
টেকনিক
ভরপেট প্রথমান্ন খেয়ে কানাই দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির দিকে। ভরপেট বহুতল খেয়ে খুঁটিয়ে দেখছে পাতালের বুক ও পাছা। হাড় হিম হচ্ছে হিমের হাঁ ও আড়ে। মা এবং ধুমা জুড়ে এই আমার মধ্যমা। চুরি করলো কানাই। তাকে নিয়ে ফিরে যাই ট্রেনে।
শ্রাবণ আমার টেকনিক। শ্রাবণে।ভরে যাচ্ছে মহাপ্রস্থানের গজ। তাই কি মগজ? ঝরে যাচ্ছে বাগানের টেকনিক ধরে।প্রিয় বকুলে হাল্কা হচ্ছে মুখ। কাকের ডাক আর নাই।শুধু কানাই। তার রক্ত, মাংস, হাড়। ভরপেট প্রিয়তম খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে কানাই। হাসির টেকনিক মেখে টিপটপ, আমার মধ্যমায় , তোমার চাতালে।
ফল
অসাধারণ গাছের ফল হালকা হলেই গাড়ি হয়ে যায়
বাচ্চাদের চৌমাথা অঙ্কের জন্য
ফেরায়
সাধারণ গাছের ফল
প্রতিদিন রিমা রুমার থেকে সাতবার বেশি দুধ দ্যায়
সাতবার বেশি ঘুরে সাতাত্তর হয়
আলাদা বৃত্ত আলাদা কোণ
আলা দা আলা দি সমীকরণ…
ই-কার আ-কার
ফ র র ফ র র পিক পিক পিক চিকম্ চিকমম্
ফটফটির উল্লাস ঙ-য় হৌম আবেগে
হাঙরের মতো বহুতল
নানাময়ী বিড়াল
ধর্মে হ, বর্ণে হ…
পৃথিবী ফুলে ফল হতে গিয়ে খাদ্য খাদক দূরে সরে যাও
মীন থেকে মতিয়ান
স্বর্গে হ , মর্ত্যে হ…
এমন বিয়োজক ওরা…
ঞ’র দুটো থলি আড়াআড়ি ভাগ ক’রে নাও
শিকারী ধূপ দিয়ে গেলে
পুজো হবে অন্ধমুনির পা
ভীতগাব ভোগান্ত রিদেলীন রুম থেকে অনায় পতন , অন্য কাকের খোঁজে
অন্ধে হ, সন্ধ্যে হ…
অন্ধকার বাজিয়ে নিলো ই-কার, আ-কার…
হৈ হৈ
তনতনের কুমার, একমাস বাকি থাকতেই ধিক-ধিক… ধিক-ধিক…
মধুসূদন ঘুমোতে যাও, সাক্ষরতার পর
আহ্ননীও চল-চল
অন্নদামঙ্গল
দুর্বল
জল
টুকরো টুকরো জন্মতারিখ দাও মাংসের বদলে…
টোপ টুপ টাপ টপ টেপ ধ’রে বনন
টিপ নিয়ে ট্রলারে বসুন,
শাঁসে-জলে ছেলে-মেয়ে মধ্যিখানে, লিচু মুখে অমুক য্যামন…
ধ্বনি সরকার তাদের কাপড়ে সিংহভাগ হৈ হৈ
আমার কাছে শুনতে ভালো বাউন্ডারি ও গরু বাছুরের প্রাতঃভ্রমণ
যেখানে কংসাবতী গান লেখে
কুহু কুহু কুহু
কুয়াশার প্রতিযীশু প্রতিকবিতার গায়ে
ঝিক ঝিক ঝিক…
টালিময়
ফলিত টেলিমায় আশ্চর্য মেটালিকা
মে নয় টাল নয় মেয়েদের আশ্চর্য গরমে
ছেলেদের রাহাজানি হয়
আমি দেখছি ডুবন্ত
কারিগর
মাছকারিগর তাদের গড়নে
কেজি ভেঙে গ্রাম
গ্রাম ভেঙে শহরের দিকে
পালিত লজিক
টালিময়
টাল নয় মে নয় মাছ ভাসে ‘আশ্চর্য’ বানানে
ছিপ দিলে মেয়ে ওঠে
ছেলেদের ‘ছিনতাই’ হয়
ভাঙতে ভাঙতে টেলিমায় দেখি
ফলিত বাঙালী সেরা হতে হতে
ছেঁড়া পা পোষে হামাগুড়ি দ্যায়…
ইউরেকা
*
৬৪ রকমের পিছনের দিকে তাকাতে তাকাতে লেজ তোলা উচ্চ হাস্য , বস্ত্রস্খলন প্রভৃতির ব্রিজের উপর প্রবালমণি , আকাশে বিরক্ত লিঙ্গ , নিষ্কাশনের বিশেষ উপায় , তাকাতে তাকাতে ৬৪ রকমের কপাটির পর কপাটি বসিয়ে ভগবানের গবাদি হয়ে এসো , কারণ পুরুষের ঊরুর নিচে প্রচণ্ড চাপে ও তাপে রাখা হচ্ছে বাঁহাত দিয়ে আলিঙ্গন করার বিশেষ নিয়ম , সুকুমার অবস্থায় কিছু বৈদিক পাখি ডুবছে প্লবতায় , ফুটছে ডিম রাখা ভাসনের বিশেষ নিয়মে । উপরের কারণ দুটির মধ্যে প্রণয়ের কোনো প্রয়োজন না থাকায় সরাসরি পশুদের মধ্যে ঢুকে ইউরেকা শব্দ করে বেরিয়ে এসো।
**
সহস্র যোনির রাতের খাবারে বিশেষ নিয়ম , গ্লাসে রাখা অজীর্ণ , উৎফুল্ল হয়ে
ঘোড়া-হাতির হাজার হাতে
প্রথমায় - রেডিও ওয়েভ
দ্বিতীয়ায় - মাইক্রো ওয়েভ
তৃতীয়ায়- ইনফ্রারেড
চতুর্থীতে- স্যাটেলাইট
পঞ্চমীতে -ব্লু টুদ
ষষ্ঠীতে শুধুই আলো
***
ছেলেদের খেলার ছলে ৬৪ রকম দ্রৌপদী নড়ে ওঠে। রাগ কাল পেরিয়ে ছেলেধরা হয়ে ওঠে। কখনো কখনো ছোটো আকারের বিছানায় দ্বিতীয় অংশের রেডিও বাজে, লেবুর ছাল চূর্ণ করে লিটল ম্যাগাজিনের আকাশে রাখো , পুরসভার গায়ে ঘাম দেখা দিলে মুছে ফেলার চেষ্টা না করে বুকে সূর্যঘড়ি লাগাও... ছেলেদের পিচকারিতে দ্রৌপদীর লিঙ্গ নেবে ৬৪ রকমের মর্তমান কলায়
****
কানাড়া ম্যাম জঘনের সাথে ১৪৪ ধারায় আটকে গেলেন , জুজুর সাথে আয়নায় মেলাতে মেলাতে প্রমিথিউসকে উস্কে দিলেন বিকিরণের বিটুমিনাসে । ওখানে নিউটনের চাকতি ঘোরে , ওখানেই নিউটন সিগনালে আটকে যায় বড়োরানী। শশক জাতীয় লালনে কানাড়া ম্যামের আলম্ব ১৭ মিটার ঘরে , ৩৪ মিটার ঘরে , বাচ্চাদের স্বাধীনতা দেয়। আলো নিয়ে শব্দ আসে , শব্দ নিয়ে আলেয়ায় ...
*****
এইচ পি-র আনন্দ গান পি-এইচ জানে , পীযূষ-ও সে ভাবেই দোকানে চন্দ্রবিন্দু রাখে , বিক্রি হয় বিপ পিপ বা সর্বসমেত একটি সিপ-ও ওর পছন্দ নয় , ফলে সমস্ত বোতলেই ‘?’ চিহ্ন পোরে , খদ্দের আসে, কেউ অম্ল, কেউ ক্ষার , কেউ আবার কিছুই নয় , শুরু হয় বিপরীত বিহার , কখনো হাতি , কখনো শাঁখ , কখনো ঘোড়া , কখনো আবার হরিণ হয়ে ওঠে... কখনো একান্তর কোণে আটকে গেলে HppH সার্কাস শুরু করে
ধেনুক হয়ে ডুবে যায় , ধেনুক হয়ে ডুবিয়ে যায়...
বিকর্ণ
সূর্যের কেলেঙ্কারি ভুলে একজোড়া মুখ চাঁদের বিকর্ণ গাইবে
শিশুর অর্ণব থেকে পাশের কোল
ও
বালিশের সংক্ষিপ্ত মা
বাংলা বাজার উড়ে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ ত্বকের দিকে…
ত্বকের গন্ধে মিলন , ছোঁয়ার ছন্দে মলিনা পায়ে পায়ে নাচিয়ে তুলছো জল
জলের যোগ্য আকাশ
স্রোতের জন্য হাওয়া
মাছের গল্পে রাঁধুনিকে পড়ে শোনাচ্ছে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’…
নোদানো
সকাল বেলার ঝাপটে বিপুলের পুল ধ’রে এগোচ্ছি ঝাউ। তোর্সা যখন নামবে ঠিক হোলো তখনই তরঙ্গদি ঝুমুরদি’র খাল পাড় থেকে… বিছিয়ে বানিয়ে টেক্সাস হোলো । তরঙ্গ রইলো না। তরঙ্গের বিলকুল রই্লো না। ঝুমুরদি শুকোলে ওই ঝামুর মুড় মুর ধ্বনি কেউ খায়। খ্রীষ্ট ধ’রে খায়। ইষ্ট পালিয়ে গেলে সেই সংবাদ, লুকিয়ে দাও চুরিয়ে দাও, সারেঙ্গীদা’র হাটে বাজারে…
সুড়ঙ্গ নেই, ববি নেই, ফিশার নেই। মাছের বাইরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করছে নদী।
তাই নদীকে আটকে রেখেছি দাবাপ্রেমের বাইরে। দাবিয়ে প্রেম করলে তরঙ্গদি কণা হয়ে যায়। দু-কোণা রেজিনা ছেড়ে রোদানো গাইবে দানো নোদানো চোখ। ঝুমুর দি’র কই খালি থেকে কয়েক কেজি চলে গেল সারেঙ্গী দা’র হাটে , সাগা রেমা’র বাজারে।
বরংপ্রিয়
উপভোগ করুন আপনার পাতাল
সেখানে হরিম রহিম ও মহির আছে সাবধানে
এইমাত্র ভেঙে পড়লো ওরা প্যাটার্ন ছাড়া
এককাপ হেনায়
মধু দেখলো পাতালের পোকা মৌমাছি নয়
প্রিয়ংবদা এযাবৎ ঘুম ভাঙা ‘ত’ খণ্ডে খণ্ডে
যাবতীয়
পাতাল ভারতের
অতল ভারতীয়
বদলে দিন মধু
পাতাল ভারতীয়
অতল ভারতের
কিছুই গ্যালো এলো না
বরংপ্রিয় পাখি ওড়ে না বসে না
প্যাটার্ন ছাড়া পা
তালে তালে দেখি
প্রিয়ংবদা হরিমের রহিমের
অথচ মহিরের নয়…
টিপ্পনি
টেপা ভূগোল তাই টিপ্পনি
মাদল বাজছে যমালয়ে
আমি টিপ দেখে ট্রিপ্ করছি পাতানুকূলে
যম দেখছে হাঁড়ির নিচে লুকিয়ে রাখা দেহ
ওদের ট্রিগারে বাজে ট্রি ট্রি ট্রা ট্রা
যম এলো আমার নাগালে
আমাকে চাঁদ ভেবে ভুল করলো রানুদি
উলটো চেপে ইন্দ্রানী আমি গুনলো আমি
বয়স্ক তারার পাশে অযম বাবু
ফিসফিসিয়ে পোকা সরায় খুলি সরায়
‘ডিগবাজি’
প্রচণ্ড ডিগ্ প্রচণ্ড বা আমি রাজি
গুলিয়ে যাচ্ছে রেণু
দেখলো পালিত কাকার কাপালিকপনা
ইন্দ্রানীর পাখি তুমি
উড়ে যাচ্ছো প্রাণে মজালয়ে
হাসিপনের পর!
আলোচনা করলেন অমিতাভ মৈত্র
এই কবিতাগুলি পড়বার আগে আমি কয়েকটি বিষয় ঠিক করে নিয়েছিলাম। যেমন আমি বিন্দুমাত্র খোঁজার চেষ্টা করবো না যে এই কবিতাগুলির আড়ালে থাকা কলমটি কার। ঘোড়ায় চড়ে যে নাইট শিরস্ত্রানে মুখ অচেনা করে দাঁড়িয়ে, তার মুখের দিকে আমি চোখ তুলে তাকাবোনা পর্যন্ত।
কবিতার শব্দ, যে কোন মৌখিক ভাষার মতই, চিহ্ন। পাঠের জন্য কবিতা, এই শব্দের কাঁধে ভর দিয়েই আসে। কবিতায় দাঁড়ি কমা লিডার চিহ্নগুলিও গুরুত্বপূর্ণ। শুধু একটি মাত্র অবাঞ্ছিত উপস্থিতি সেই কবিতায়- যা জ্বলজ্বল করে- যা কবির নাম। কবির নাম সংক্রান্ত এই উপদ্রবটি- যেহেতু প্রতিবাদ করতে পারেনা সে- কবিতাকে বহন করতে হয়। একটি নামের মধ্যে জ্বলজ্বল করে কবির অহম। যেন তিনিই ঈশ্বর সেই কবিতাটির। যেন তাঁর নামের মর্যাদাই কবিতাটির সৌভাগ্যে প্রকাশিত হল। বছর পনেরো আগে 'কবিতা পাক্ষিক' যৌথ কবিতা রচনার কয়েকটি কর্মশালার আয়োজন করেছিল যেখানে সারাদিনে বসে থাকা কবিদের হাতে হাতে ঘুরতো একটি খাতা আর মুহূর্তের মধ্যে কয়েকটি নামচিহ্নহীন লাইন লিখতেন কবি এবং এভাবেই লেখা হতে থাকতো কয়েকশো লাইনের ধারাবাহিক কবিতা যেখানে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে কবিদের মুখ। শুধু কবিতা থেকে যাচ্ছে। ভাঙার এই রকম সব চেষ্টা কবিতাকে ক্রমাগত আপডেট করে যায়। যে কয়েকটি কবিতা "রেহেল" পড়তে দিয়েছে আমাকে তার মধ্যে শূন্যদশক ও তার পরবর্তী সময়ের কবিদের এক নিজস্ব নির্ভুল ছাপ রয়েছে।
“ভরপেট প্রথমান্ন খেয়ে কানাই দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির দিকে। ভরপেট বহুতল খেয়ে খুঁটিয়ে দেখছে পাতালের বুক ও পাছা। হাড় হিম হচ্ছে হিমের হাঁ ও আড়ে। মা এবং ধুমা জুড়ে এই আমার মধ্যমা। চুরি করলো কানাই। তাকে নিয়ে ফিরে যাই ট্রেনে।
শ্রাবন আমার টেকনিক। শ্রাবনে। ভরে যাচ্ছে মহাপ্রস্থানের গজ। তাই কি মগজ? ঝরে যাচ্ছে বাগানের টেকনিক ধরে। প্রিয় বকুলে হাল্কা হচ্ছে মুখ। কাকের ডাক আর নাই। শুধু কানাই। তার রক্ত, মাংস, হাড়। ভরপেট প্রিয়তম খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে কানাই। হাসির টেকনিক মেখে টিপটপ, আমার মধ্যমায়, তোমার চাতালে”।
প্রথম লাইনেই কবিতাটি বিস্মিত ও অসহায় করে দেয় আমাকে। চুপচাপ মাথার মধ্যে ক্ষরণ হতে থাকে যেন কিছুর। "ভরপেট প্রথমান্ন খেয়ে কানাই দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির দিকে।" বাংলা কবিতায় এই স্বর সম্পূর্ণ নতুন। শব্দকে উন্মাদ ড্রামের মতো বাজিয়ে বাজিমাত করা। কিন্তু এই ড্রামের ভেতরে ভেতরে সুর তুলে যায়, নীচু স্বরে , কোনও পিয়ানো “ভরপেট প্রিয়তম খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে কানাই। হাসির টেকনিক মেখে টিপটপ, আমার মধ্যমায়, তোমার চাতালে” অথবা “শ্রাবনে ভরে যাচ্ছে মহাপ্রস্থানের গজ” দু-ধরনের দু-রকম শূন্যতা হাত ধরে যেন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কবিতাটিকে। আমি বিস্মিত হয়ে দেখছি "ভরপেট প্রথমান্ন" "ভরপেট বহুতল" "ভরপেট প্রিয়তম" খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব এক কানাইকে। চলতি হাওয়ার কবিতা পড়ার অভ্যাসে পাঠক যদি এই কবিতার বাচ্যার্থ, লক্ষনার্থ, বাকপ্রতিমা ইত্যাদি খুঁজতে শুরু করেন, তার ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। যেমন এবারের কবিতাটিতে।
ফল
অসাধারণ গাছের ফল হালকা হলেই গাড়ি হয়ে যায়
বাচ্চাদের চৌমাথা অঙ্কের জন্য
ফেরায়
সাধারণ গাছের ফল
প্রতিদিন রিমা রুমার থেকে সাতবার বেশি দুধ দ্যায়
সাতবার বেশি ঘুরে সাতাত্তর হয়
আলাদা বৃত্ত আলাদা কোণ
আলা দা আলা দি সমীকরণ…
এই কবিতাটির প্রথম লাইনেও একটি পূর্ণ কবিতার স্বাদ রয়েছে, আগের কবিতাটির মত। পরের লাইনের "চৌমাথা অঙ্কের জন্য", "সাধারণ গাছের ফল", "প্রতিদিন রিমা রুমার থেকে সাতবার বেশি দুধ দ্যায় / সাতবার বেশি ঘুরে সাতাত্তর হয়" - চারটি শিশু মাথা গুঁজে সাধারণ গাছের ফলকে অসাধারণ করে তুলতে। কিছু সংখ্যার অর্থহীনতা, অবাস্তব ধাঁধার মতো পাটিগনিতের অগনিত পাটির পরে ফল হালকা হবে, গাড়ি আসবে। আলা দা আলা দি, আলা কাক, আলা কাকু শব্দগুলোর মধ্যে একধরনের কনজিওরিং ম্যাজিক আছে। যাদের চোখে কনজারটিভাইটিস, তাদের বিস্ময়কে এরা তীক্ষ্ণাগ্র না করতেও পারে। এবার আর একটি চমকপ্রদ কবিতায় ফরর ফরর করে উড়ে বেড়ানো যাক। পাটিগনিতের পর যা বর্ণের রং ও ধ্বনি কে আশ্রয় করে পিক পিক পিক চিকম চিকমম করছে।
ই-কার আ-কার
ফ র র ফ র র পিক পিক পিক চিকম্ চিকমম্
ফটফটির উল্লাস ঙ-য় হৌম আবেগে
হাঙরের মতো বহুতল
নানাময়ী বিড়াল
ধর্মে হ, বর্ণে হ…
পৃথিবী ফুলে ফল হতে গিয়ে খাদ্য খাদক দূরে সরে যাও
মীন থেকে মতিয়ান
স্বর্গে হ , মর্ত্যে হ…
এমন বিয়োজক ওরা…
ঞ’র দুটো থলি আড়াআড়ি ভাগ ক’রে নাও
শিকারী ধূপ দিয়ে গেলে
পুজো হবে অন্ধমুনির পা
ভীতগাব ভোগান্ত রিদেলীন রুম থেকে অনায় পতন , অন্য কাকের খোঁজে
অন্ধে হ, সন্ধ্যে হ…
অন্ধকার বাজিয়ে নিলো ই-কার, আ-কার…
কবিতাটি পড়তে পড়তে বারবার মনে পড়েছিল হিচককের "পাখি" ছবিটি। সরাসরি নয়। একটু ঘুরপথে। 'লিডার' চিহ্নগুলো যেন বসার একটু পরেই আবার ডানা মেলে দিচ্ছে। থিতু হচ্ছে না।
একটি সাদামাটা লাল টিপ যেমন মায়ের মুখকে প্রতিষ্ঠিত করে, কবিতায় একটি দুটি লাইন তেমনি সম্পূর্ণ কবিতাটিকে প্রতিষ্ঠা দেয়। পরের কবিতাটির কাছে আমি বারবার ফিরে আসতে চাইব "মাছের বাইরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করছে নদী" - শুধু এই লাইনটির জন্য।
নোদানো
সকাল বেলার ঝাপটে বিপুলের পুল ধ’রে এগোচ্ছি ঝাউ। তোর্সা যখন নামবে ঠিক হোলো তখনই তরঙ্গদি ঝুমুরদি’র খাল পাড় থেকে… বিছিয়ে বানিয়ে টেক্সাস হোলো । তরঙ্গ রইলো না। তরঙ্গের বিলকুল রই্লো না। ঝুমুরদি শুকোলে ওই ঝামুর মুড় মুর ধ্বনি কেউ খায়। খ্রীষ্ট ধ’রে খায়। ইষ্ট পালিয়ে গেলে সেই সংবাদ, লুকিয়ে দাও চুরিয়ে দাও, সারেঙ্গীদা’র হাটে বাজারে…
সুড়ঙ্গ নেই, ববি নেই, ফিশার নেই। মাছের বাইরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করছে নদী।
তাই নদীকে আটকে রেখেছি দাবাপ্রেমের বাইরে। দাবিয়ে প্রেম করলে তরঙ্গদি কণা হয়ে যায়। দু-কোণা রেজিনা ছেড়ে রোদানো গাইবে দানো নোদানো চোখ। ঝুমুর দি’র কই খালি থেকে কয়েক কেজি চলে গেল সারেঙ্গী দা’র হাটে , সাগা রেমা’র বাজারে।
যেমন পরের কবিতাটি আমি পড়বো নাস্ত্রাদামুসের কোনো ভবিষ্যদ্বানীর মতো প্রথম লাইনটির জন্য। এই এক পাতাল সারাক্ষণ সাথে সাথে থাকে আমাদের।
বরংপ্রিয়
উপভোগ করুন আপনার পাতাল
সেখানে হরিম রহিম ও মহির আছে সাবধানে
এইমাত্র ভেঙে পড়লো ওরা প্যাটার্ন ছাড়া
এককাপ হেনায়
মধু দেখলো পাতালের পোকা মৌমাছি নয়
প্রিয়ংবদা এযাবৎ ঘুম ভাঙা ‘ত’ খণ্ডে খণ্ডে
যাবতীয়
পাতাল ভারতের
অতল ভারতীয়
বদলে দিন মধু
পাতাল ভারতীয়
অতল ভারতের
কিছুই গ্যালো এলো না
বরংপ্রিয় পাখি ওড়ে না বসে না
প্যাটার্ন ছাড়া পা
তালে তালে দেখি
প্রিয়ংবদা হরিমের রহিমের
অথচ মহিরের নয়…
শব্দ জুড়ে নতুন শব্দ তৈরি করার বিখ্যাততম ঈশ্বর ছিলেন সুকুমার রায়। “হাঁসজারু”, “বকচ্ছপ” “ট্যাঁশগরু” আমাদের শিরায় একশো বছর আগেই ঢুকিয়ে দিয়েছেন। তাঁর পর শিবরাম চক্রবর্তী অসম্ভব কিছু কাজ করলেন। আমার মতোই বয়সের গাছ পাথর নেই যাঁদের তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে গৌরকিশোর ঘোষ যখন "আজকাল" সংবাদপত্রের প্রধান, তখন প্রথম পাতার একদম বাঁদিকে অর্থাৎ প্রথম কলমে, প্রত্যেকদিন নানারকম শব্দ-খেলার ভেতরে সংবাদ দেওয়া হতো। শব্দ নিয়ে আমি শিবরামের চমৎকার দুটি মজাদার উদাহরণ স্মৃতি থেকে দিলাম-
যিনি একটি দোকানের সাইনবোর্ডকে চিরস্মরণীয় কবিতা করে দিয়েছেন যখন লিখেছেন
“হরেকরকমবা জিওবা রুদেরকা রখানা”
বা অসামান্য একটি সংস্কৃত শ্লোক সৃষ্টি করেছিলেন -
“হবর্তাবা কহিপ্তাসা টজেগেন শকেডুত্র
আন্ডিবঃ অন্ডফ্রয়েন মানস্টেট শিবাঙ্গব”
যা উলটো করে লেখা সে যুগের কয়েকটি খবরের কাগজের নাম। শেষ থেকে নাম গুলো পড়া যাক - ১) বঙ্গবাসী ২) স্টেটসম্যান ৩) ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া ৪) এডুকেশন গেজেট ৫) সাপ্তাহিক বার্তাবহ।
জেমস জয়েস আর তাঁর সম্ভবত একমাত্র শিষ্য স্যামুয়েল বেকেট ও শব্দ নিয়ে প্রচুর ভাঙচুর করেছেন। জেমস জয়েসের "ফিনেগানস ওয়েক" কে ভেঙে পড়া যায় এভাবে - ফিন ইজ এগেন আ্যওয়েক বা স্যামুয়েল বেকেট এর "godot" কে গড এবং ডট (অর্থাৎ শূন্যতা), বা Malonedies কে- এম আ্যলন ডাইজ হিসেবে পড়া নিশ্চয়ই যায়। "গোডোর প্রতীক্ষায়" নাটকে লাকির একটি দীর্ঘ ভাষণের একটু একটু পড়লে দার্শনিকদের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া বেকেটের হাসির হার্পুন এর সাথে আমাদের তথাকথিত কবিতাকেও যেন একটু বোঝার চেষ্টা করেছেন নিজের ধরনে। প্রভু পোজোর ক্রীতদাস লাকি গলায় বাঁধা দীর্ঘ মোটা দড়ি আর জিনিসপত্রের ভারি বোঝা নিয়ে প্রভু পোজোর নির্দেশে যা করে তা যেন চিরকালের জন্য আমাদের কবিদেরই ললাট লিখন। মাঝে মাঝে দড়ি টানার হাত শুধু বদলে যায়। অংশটি পড়া যাক-
"এস্ট্রাগন: অপেক্ষা করছে কি জন্যে?
পোজো: পেছনে সরে দাঁড়াও! (ভ্লাডিমির এবং এস্ট্রাগন লাকির কাছ থেকে দূরে সরে যায়। পোজো দড়িতে টান দেয়। লাকি পোজোর দিকে তাকায়।) চিন্তা কর, শুয়ার! (একটুক্ষণ চুপচাপ। লাকি নাচতে শুরু করে।) থাম। (লাকি থামে) সামনে। (লাকি এগিয়ে আসে) থাম। (লাকি থামে) চিন্তা কর। (নীরবতা)
লাকি: পক্ষান্তরে, এ সম্পর্কে-
পোজো: থাম। (লাকি থামে) পেছনে। (লাকি পিছনে সরে) থাম। (লাকি থামে) ঘোর। (লাকি প্রেক্ষাগৃহের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়) চিন্তা কর।
(লাকির বক্তৃতাকালে অন্যদের মধ্যে নিন্মোক্ত প্রতিক্রিয়া লক্ষিত হবে।)
[১. ভ্লাডিমির এবং এস্ট্রাগন গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনে পোজো বিমর্ষ এবং বিরক্ত ২. ভ্লাডিমির এবং এস্ট্রাগন আপত্তি জানাতে শুরু করে পোজোর যন্ত্রণা বৃদ্ধি পায়। ৩. ভ্লাডিমির এবং এস্ট্রাগন আবার মনোযোগী পোজো আরো উত্তেজিত, আরো বেদনার্ত ৪. ভ্লাডিমির এবং এস্ট্রাগন প্রচন্ড প্রতিবাদ করে, পোজো লাফিয়ে উঠে দড়িতে টান দেয়। সবার চেচামেচি, লাকিও দড়ি ধরে টানে, প্রায় পড়ে যায়, চিৎকার করে নির্ধারিত বক্তব্য উচ্চারণ করতে থাকে। ওরা তিন জন তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, লাকি যুঝতে থাকে চিৎকার করে বক্তৃতা চালিয়ে যায়।]
লাকি: পুঞ্চার এবং ওয়াটম্যানের গ্রন্থাদিতে উচ্চারিত ব্যক্তিগত ঈশ্বরের অস্থিত্ব ধরে নিলে কোয়া কোয়া কোয়া কোয়া কোয়া কোয়া তার সঙ্গে সফেদ শ্মশ্রু নিয়ে কোয়া কোয়া কোয়া কোয়া কোয়া কোয়া। অন্তহীন সময়ের বৃত্তের বাইরে যিনি স্বর্গীয় নিষ্করুণতী স্বর্গীয় নিষ্করুণিয়া স্বর্গীয় নিষিয়ার চূড়া থেকে আমাদের গভীরভাবে ভালোবাসেন কিছু ব্যাতিক্রমসহ কারণ অজ্ঞাত কিন্তু সময়ে জানা যাবে সব এবং কারণ অজ্ঞাত কিন্তু সময়ে জানা যাবে এমন কতিপয়ের সঙ্গে যারা চরম যন্ত্রণার গহ্বরে স্বর্গীয় মিরান্ডার মত কষ্ট সহ্য করেন অগ্নিতে নিমজ্জিত যে অগ্নিরশ্মি যদি জ্বলতে থাকে এবং কে সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ পোষণ করতে পারে আকাশকে পর্যন্ত জ্বালিয়ে দেবে অর্থাৎ নরককে বিস্ফোরণের মত ঠেলে দেবে স্বর্গ পর্যন্ত এত নীল নিস্তব্ধ প্রশান্ত এত প্রশান্ত যদিও খন্ডিত তবু কিছু নাইর চাইতে শ্রেয় কিন্তু এত দ্রুত নয় এবং সব কিছু বিবেচনা করে যেটা আরো বড় কথা যে অসমাপ্ত পরিশ্রম যা নাকি সাফল্যের সঙ্গে সমাপ্ত করেছে একাকাকাকাডেমী অব এ্যান্থ্রোপোপোপোমেট্রি অব ইসে-ইচ-পসি অব টেসটিউ এ্যান্ড কানার্ড যার ফলশ্রুতি হিসেবে এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সকল রকম সন্দেহের বাইরে যে মানুষের পরিশ্রমের সঙ্গে যা যুক্ত যা টেসটিউ এ্যান্ড কানার্ডের অসমাপ্ত পরিশ্রমের ফলশ্রুতি হিসেবে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা অতঃপর কিন্তু এত দ্রুত নয় কারণ অজ্ঞাত বা পুঞ্চার এবং ওয়াটম্যানের গ্ৰন্থাদির ফলশ্রুতি হিসেবে সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে ফার্টভ এবং বেলচারের গবেষণার প্রেক্ষিতে যা অসমাপ্ত রয়েছে অজ্ঞাত কারণে টেসটিউ এ্যান্ড কানার্ডের কাজ অসমাপ্ত কারণ অজ্ঞাত এটা প্রতিষ্ঠিত যে অনেকেই মেনে নিতে অসম্মত যে টেসটিউ এ্যান্ড কানার্ডের পসিতে মানুষ যে এসিতে মানুষ যে সংক্ষেপে মানুষ এক কথায় মানুষ এলিমেন্টেশন এবং ডেফিকেশনের অগ্রগতি সত্ত্বেও ক্ষয়ে যাচ্ছে শুকিয়ে যাচ্ছে ক্ষয়ে যাচ্ছে এবং শুকিয়ে যাচ্ছে এবং..."
চাবুকের শব্দে, ও অত্যাচারের আশঙ্কায় লাকি যা বলে যায় - ভারী ভারী শব্দের অনর্গল অর্থহীন উচ্চারণ (কেননা তাকে বলা হয়েছে চিন্তা করতে) যেন সেই গভীর চিন্তার ফসল।
সেই চিন্তা ভরে উঠছে ব্যাঙের "কোয়া কোয়া কোয়া" শব্দে। একাডেমী শব্দটির মধ্যে ঢুকে গেছে কাকের কা কা ডাকের আওয়াজ (ফরাসি ভাষায় “কাকা” মানে বিষ্ঠা), খুব ভাবগম্ভীর ভাবে এসেছে "ডেফিকেশন" যা আসলে বিষ্ঠামোচন।
সূক্ষতম আর উচ্চতম অবস্থায় ভাষায় কবিতার গুণ চলে আসে। এই ধারনা থেকে এখনও সরে যাওয়ার কোন ধ্বংসাত্মক কারণ নেই। কিন্তু সেই ভাষাকে উন্মাদ করা হচ্ছে প্রয়োজন ভিত্তিক। প্রয়োজন। আমি আমার জীবন থেকে উঠে আসা কবিতার ভাষাকে এইভাবে দেখিয়ে বাহবা চাইবো, কিন্তু নিজের নাম বদলে দেবনা। “ফেকহাম পেকহাম ফুলহাম” নামে অমিতাভ মৈত্ররা কবিতা লিখবে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন