
কবির নাম, বয়স, লিঙ্গ, ঠিকানা ইত্যাদি যা কিছু কবিতার জন্য জরুরি নয়, তা আমরা মুছে দিয়েছি। আর এভাবেই ১০টি কবিতা পাঠানো হয়েছে অন্য এক কবির কাছে- আলোচনার জন্য। শুধু ১০টি কবিতা, আগে পরে নাথিং। আমাদের সাথে রুমালচুরির এই খেলা খেললেন ১৯ জন কবি।
এখানেও কবির নাম ছাড়া ১০টি কবিতা রাখা হল, সঙ্গে থাকলো আলোচনা। কবির নাম জানার রাস্তা কবিতার নীচ দিয়ে গেছে। তবে আমরা বলবো রুমালচুরির এই খেলায় আপনিও থাকুন। কবির নামটা না হয় একটু পরেই জানলেন।
১০টি কবিতা
গাজন
একটি চৈত্রের ঘোর
যদি জল ভালোবাসে
আমি তবে শ্বাসে ও প্রশ্বাসে
ঘূর্ণিপথে উড়ি দেহমাখা ধুলো আর
দেখ ক্ষুধামাখা
ঘোরে ঘোরে ঘনঘোরে
বিজয়পতাকা।
খাঁচা
ঘুঘু নামে পাখি ডাকে
আমার জঙ্গলে
ডাকে কোকিলেরা
শালিখেরা ডাকে
কোকিল, শালিখ নামে পাখি
ঘুম ভাঙে, ভাঙা ঘুম
আমার সংসারে
আমার রন্ধনে ডাকে পাখি
আমার বন্ধনে ডাকে পাখি
তোমাকেই রাখি
বনাঞ্চলে, ব্যক্তিগত
বনের অঞ্চলে
কত কলে, কৌশলে কৌশলে
লিখে চলি যৌনপ্রহেলিকা
মননের মধু জাগে
জীবন, জীবিকা
খাটাল
গরম গরম ফেনা, দুগ্ধফেনা
সবই জানা
খড়বাছুরের জানা
মোহিনীমিলের পাশে
বন্ধ কারখানাটির পাশে
মহিষেরা ডাকে
গাই ও বাছুর ডাকে
মনুয়া যাদব রাখে, বাটে রাখে
বিশ্বাস-অবিশ্বাস রাখে
আমিও রকমফেরে
প্রশাখায়, শাখে
দুলে দুলে দেখে যাই
দুগ্ধপ্ররোচনা
ডাকঘর
চিঠি, চিঠিপটে, স্মৃতিপটে লেখা
আমাদের দেখা
বরফের পিনকোড
পাঙ্খাবাড়ি রোডে
নামে মৃত্যুঘনপ্রাণ
শোণিতে শোণিতে বাজে
আমার আজান
পুনঃ পুনঃ জাগে
আমার এ-দেহখন্ড
রাগে ও পরাগে
ইস্কুল
গ্রীবা গ্রীবা শূন্যগ্রীবা
চক্ষু চক্ষু অক্ষরে অক্ষরে
গৃহী ও তস্করে
দাবা খেলে, অপরাহ্নবেলা
আমাদের খেলা
কূটগন্ধময়
যেরূপে যুদ্ধের জয়
অন্ধকারে ডাকে
কাক, ঘেয়ো কাক, মৃত কাক, জাত কাক
আকাঙ্ক্ষার ফোকরে ও ফাঁকে
স্টেশন
গাড়ি আসে, লোকাল ও মেল
মালগাড়ি, ঝিক ঝিক ঝিক
চাকায় চাকায় টিক টিক
স্মৃতিহত্যা
স্মৃতিমেদুরতা
আমাদের কেতা, অপকেতা
চন্দ্রিমায় লীন
ক্ষীণ, অতি ক্ষীণ
কন্ঠ কাঁপে
উত্তাপে উত্তাপে
ওষ্ঠ বহ্নিমান
স্টেশনে স্টেশনে ঘুরি
আমিও, শয়ান
বাজার
ইঁদারার থেকে আসে
উঠে আসে
কার ছায়াঘোর
আমাদের জ্বর
কামনাকাঙ্ক্ষিত
সন্ধ্যা এল, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীতও
অতলান্ত পীত
পীতিবস্ত্র আকাশে বাতাসে
আজও ওড়ে
আমার এ-দেহ পোড়ে
জলে-স্থলে পোড়ে
সাদা কালো লেখা
এক
তুমি শুধু মাংস কর, আমি ঘুম যাই
দেখি চাঁদ চাঁদের বাহিরে চাঁদ মারে
চন্দ্রচিহ্ন ভেসে চলে শূন্যরেখাধারে
শূন্য গৃহ, শূন্য গেহ, শূন্য দেহযান
যেখানে বসত করে শূন্যের আজান
অধিকন্তু দেখি আমি পক্ষিরূপ গ্রহ
আমাকে বিদ্রুপ করে প্রত্যহ, প্রত্যহ
জলে ভাসে ত্রস্ত প্রাণ, ত্রস্ত নিশাচর
চাঁদ ভাঙি, চাঁদ খাই, চাঁদের প্রহর
পেরিয়ে পেরিয়ে আমি অস্থিরেতে যাই
দেহহীন দেহরস, রসে দেহ খাই
অতঃপর নিশ্চেতন, অতঃপর গ্রহ
আমাকে প্রাকৃতে করে প্রকৃত সন্দেহ
আমার শরীরে জাগে গৃহ কিম্বা গেহ
দুই
চুম্বনশস্যের ক্ষত চুম্বনেরে চায়
দেখি দেবীমূর্তি, দেখি নদীতে গর্জায়
বিসর্জনে ঢাক বাজে, কাঁপে জলরূপ
দেহ আর সন্নিকট দেহের অরূপ
কূপচিহ্নে জেগে ওঠে সৌরের গ্রহন
তুমি মন, মন-দেহ, তুমি দেহমন
আমার চুম্বন ক্ষত দেহশস্যে যায়
তিন
চিহ্ন অনুগত
চিহ্ন সংক্রামক
অন্ধ খোঁজে নগ্ন জ্বালামুখ
অঝোর আগ্রহে যায়
কাঁটাগাছ শরীরে গজায়
কাঁপে রাত্রি, কাঁপে রাত্রি
রাত্রি করে ক্রীড়া
চিহ্ন, গতি সমানুপাতিক
রাতের পাখিরা
উড়ে চলে দেহচিহ্নে
সুপ্ত নিশাচর
আমিও শয্যার মাঝে
অগুন্তি অঘোর
অনুগত চিহ্নে জাগি
চিহ্নে সংক্রামক
মনের শরীরে জাগে
শরীরের মন।
আলোচনা করলেন সঞ্জীব নিয়োগী
কবিতার কাছে দাঁড়ালে নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়। কেননা অবাক হতে হয়। পৃথিবীর ‘অবাক’ গুলো বলে দেয়, তোমার অজানা। সেই-সব শব্দ তো শুনেছিলে, আপাদমস্তক! শোনোনি? সমস্ত শব্দই বুঝি শ্রুত মনে হয়। তবু, শব্দ, ‘জাদু’ বানায় কীভাবে! তার যোজন-ক্রমে? সেই ‘ক্রমে’ নবতর প্রাণের সঞ্চারে…?
তোমার প্রশ্নের উত্তর তোমাকেই পেতে হবে। কিছুটা যেন স্বপ্নের ভেতর। …একা একা, জ্বলে উঠবে কিছু, যাহাকে আলোক কহিতে পার, কোনও পূর্বানুমতি ছাড়াই। নিজের তুচ্ছতা যত স্পষ্ট হয়, আলো ততই উজ্জ্বল হইতে থাকে। প্রাক্-ইতিহাস থেকে শুধু নয়, আরও কোনও সুদূর জীবাস্ম-স্মৃতি দুম্ করে এসে ওঠে চলমান সময়ের উঠোনে। …তাই কি একাত্মতা পাও!
ছম ছম করে বেজে ওঠে ধ্বনি ‘ঘুঘু নামে পাখি ডাকে/ আমার জঙ্গলে’। গায়ে কাঁটা দেয়, এই মোহময়, আসক্ত ঘোষণায়। এগিয়ে দেখি, সেখানে, কোকিল আর শালিখও ডাকে। ‘কোকিল, শালিখ নামে পাখি’। পাখিদের নামের ‘সুন্দর’ জেগে ওঠে, নিরাসক্ত; আর পাখিদের নামকরণের মানবীয় অর্বাচিনতার প্রতি কৌতুকে ভেসে, একাধারে, মেখে নিয়ে গায়ে, একটু বসে থাকি। কবিতার নাম ‘খাঁচা’। স্বভাবতই এই পাঠকের স্মৃতিবাহিত ‘অচিন পাখি’ জায়গা করে নেয়, নিজে থেকেই, কবিতার পরবর্তী গতরে ঢোকার আয়োজন-প্রাক্কালে। (এ সংবাদ কবির দিক থেকে কতটা হাস্যকর বা অবান্তর জানিনা, কিন্তু পাঠক আমাতে তা অনিবার্য্য হলো। সেই পাখির ডাকে কবির সাংসারিক ‘ঘুম’ ভেঙে যায়। আর তখন, ‘ভাঙা’ ঘুমে, ‘আমার রন্ধনে পাখি/ আমার বন্ধনে পাখি’। বন্ধনে? বটে তো, তা-ই তো! এই পারস্পরিক বন্ধন না থাকলে ‘জীবন, জীবিকা’য় ‘মননের মধু জাগে’ কীভাবে! জাগে না তো! আচ্ছা, সত্যিই কি বাঁধন এখানে, এক্ষেত্রে, এইসব ক্ষেত্রে, দ্বিপাক্ষিক? যা, একটু আগে আমি ভাবলাম? যখন ফিরে পড়ি ‘তোমাকেই রাখি/ বনাঞ্চলে, ব্যক্তিগত/ বনের অঞ্চলে’ ... তখন ভাবি, এই ‘রাখা’ কি পাখিটির অনুমোদন/সম্মতি সাপেক্ষ? সে কি সম্মত হয়েছে? অনুমোদন করেছে তাকে ‘রেখে’ দেওয়া? নাকি কবির ‘ব্যক্তিগত’ বাঞ্ছা শুধু! সুতরাং, তাই, ‘খাঁচা’ কেন? কার এই খাঁচা? কবির, পাখির নাকি দুজনের! অথবা আবহমান, চিরাচরিত, পরিত্রাণহীন! ... এই কবিতায় ‘প্রহেলিকা’ শব্দটি আছে। এসেছে এইভাবে – ‘কত কলে, কৌশলে কৌশলে/ লিখে চলি যৌনপ্রহেলিকা’। এখানে এসে মনে হয়, প্রহেলিকায় যে অপার রহস্যের ইশারা, তার কেন্দ্রে আছে যে পাখি, সে কি জানে, কতটুকু জানে, কবির ‘জীবনে’ তাকে ঘিরে ঘটে চলা প্রহেলিকার বিস্তার, গভীরতা? কবিতাটির শেষ দুটি লাইন (‘মননের মধু জাগে/ জীবন, জীবিকা’) পড়তে পড়তে চকিতে মাথায় চলে আসে জীবনানন্দ দাশ, “… সময়ের উর্ধ্বতনে উঠে এসে বধূ/ মধু- আর মননের মধু/ দিয়েছে জানিতে;…”। এতক্ষণে আমি-পাঠকের খোঁজ, কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ-সকলের অনুষঙ্গে আরও যেন নির্দিষ্ট অভিমুখের সন্ধান পেতে চায়।
কবির পরিচয় আমি জানি না। তাঁর কবিতাই আমার কাছে কবির পরিচয় বয়ে নিয়ে আসে। কবিতার শিরোনাম ‘ডাকঘর’। দ্বিতীয়বার পড়তেই ‘পাঙ্খাবাড়ি রোডে/ নামে মৃত্যুঘনপ্রাণ’ আমাকে নিজের কাছে থামায়। পাঙ্খাবাড়ি? কার্শিয়াং! খাদ পাশে রেখে পাহাড়ি পথ? সেখানে, এই কবির স্মৃতি-বেদনা লিপি হয়ে এলো আমার কাছে। আমার পথ সুগম করে দিল, পাঙ্খাবাড়ি রোড। কোনও একজনের, কবির খুব প্রিয় কারো,‘পাঙ্খাবাড়ি রোডে/ নামে মৃত্যুঘনপ্রাণ’ । তার চিঠিগুলিই এখন কবির সম্বল। ‘চিঠি, চিঠিপটে, স্মৃতিপটে লেখা’। তারপর, ‘আমাদের দেখা/ বরফের পিনকোড ’। ‘বরফের পিনকোড’ কথাটা আমার কাছে দুভাবে আসে। এক, বরফের ঠিকানা। এই বোধ-এও অকথিত তৃপ্তি পাই। ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য বোঝাতে ‘বরফের পিনকোড’ শব্দবন্ধ ব্যবহার, কবির দুরন্ত কবিত্বশক্তির পরিচায়ক। আবার আমার কাছে, যখন তারপরই আমাকে পড়তে হয়, ‘পাঙ্খাবাড়ি রোডে/ নামে মৃত্যুঘনপ্রাণ’ , তখন এই ‘বরফের পিনকোড’ যেন মৃত্যুর শীতল হাতছানি। সেই চিরবিচ্ছেদ, কবির ‘শোণিতে শোণিতে’, আজও, ‘পুনঃ পুনঃ জাগে’। কবির এ জীবদেহ, যেখানে অনিবার্য উপস্থিতি মনের, ‘মনের মানুষের’ সাথে সংযুক্তি যাকে পূর্ণতা দেয়, বিচ্ছেদে তা হয়েপড়ে নিতান্তই খণ্ডিত। ‘আমার এ –দেহখন্ড/ রাগে ও পরাগে’। ‘রাগ’ বা প্রেমের চিরন্তনতা, অমরত্ব ঘন হয় ‘পরাগ’ শব্দটির মধ্যে যে সম্ভাবনার বীজ আছে, তার অনুষঙ্গে।
কয়েকটি কবিতা আলাদা ভাবে পাঠ করতে হয়। যেমন ‘ইস্কুল’ কবিতাটা আলাদা মেজাজের। কথনে নয়, বিষয়ে। বক্তব্যে। ভিন্ন। পাঠকের প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ, এইখানে আমার এই লেখাটির পাঠ আপাতত স্থগিত রেখে কবিতাটি আরেকবার নিজের মতো করে পড়ে আসুন।...
‘ইস্কুল’, যেখানে কিছু বা কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ে শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের কাজ হয়। ঘরানা অর্থেও শব্দটির ব্যবহার হতে পারে। একটু এগিয়ে, ‘পৃথিবীর পাঠশালা’ ধারণাটিকে প্রশ্রয় দেব কিনা, পাঠারম্ভে ও পাঠান্তে একথাও ভেবে নেওয়া খুব অযৌক্তিক হয়ত নাও হতে পারে। ...দেখা যাক। ‘গ্রীবা গ্রীবা শূন্যগ্রীবা/ চক্ষু চক্ষু অক্ষরে অক্ষরে’। পাঠ নিতে গেছি আমি, শিক্ষালাভ করতে উদ্যত; আমার গ্রীবা আমার মস্তককে ধারণ করে, মস্তকের ভেতরে থাকে মস্তিষ্ক। শিক্ষার্থীর মস্তিষ্কের বহর এখানে অজানা, শুধু তার শূন্যগ্রীবার দিকে ইঙ্গিত করেন কবি। মস্তকে স্থাপিত চক্ষু(দ্বয়) অক্ষরে অক্ষরে নিবদ্ধ-চঞ্চল-শিকারি। সেই ‘শূন্যগ্রীবা’ কি অক্ষরের, যার ক্ষয় নেই, সেই সম্পদের অন্দরে প্রবেশ করতে পারে, নাকি তার চক্ষু শুধু চকমকি নির্বাচনের লোভে ও মতলবে চঞ্চল! ‘গৃহী ও তস্করে/ দাবা খেলে, অপরাহ্নবেলা/ আমাদের খেলা/ কূটগন্ধময়’। ... আসুন, শব্দগুলো নিয়ে ভাবি। গৃহীঃ যিনি যত্নে, সুবিন্যাসে, মগ্ন ভালোবাসায় সাজিয়ে তোলেন সৃজন-পৃথিবী। সম্পদের অধিকারি তিনি। সংসার গড়ে তুলতে ও টিকিয়ে রাখতে তাঁর ক্ষমতা আর উদ্ভাবনীর ক্রমবিকাশ ঘটাতে হয়, হয়েছে। তস্করঃ এই মানুষটির নজর কিন্তু গৃহীর ‘সম্পদে’। কেমন সেই সম্পদ, কবিতায় যেটুকু বলা আছে, তা, ‘অক্ষর’। তাহলে, তস্কর হলেও, তার উদ্দেশ্য সাধু না অসাধু? সেটা এখনি অন্তত বোঝা যাচ্ছে না। এগোনো যাক। অপরাহ্নবেলাঃ এই অপরাহ্ন কার? গৃহীর, তস্করের নাকি প্রাকৃতিক? যদি ধরে নিই এ হচ্ছে গৃহীর সাঙ্কেতিক বলা-শেষ, তবে কি তিনি তস্করের সাথে দাবা খেলতে বসেছেন ইচ্ছাকৃত হার স্বীকার করে তাকে কিছু দিয়ে যেতে? তস্করের কোনও অতিপ্রাকৃত বা আধ্যাত্মিক ‘অপরাহ্ন-বোধ’ থাকার কথা নয়; থাকলে তিনি পথপরিবর্তন করতেন। এই অপরাহ্ন যদি প্রাকৃতিক হয়, তাহলে সেটা এমনিতেই তস্করের পক্ষে যায়। এই পাঠকের কৌতূহল হয়, আচ্ছা, গৃহী কেন তস্করের সাথে ‘দাবা’ খেলতে বসলেন! এই কৌতূহলের উদ্রেকে উত্তরের ইঙ্গিতও পেয়ে যাইঃ ‘আমাদের খেলা/ কূটগন্ধময়’। কটু নয়, কূট! এবার বুঝতে পারি, যে খেলার কথা বলা হচ্ছে, যে কিস্তি-মাতের ছক সাজানো আছে, তা পরিত্রাণহীন। দেওয়া ও নেওয়ার ‘কূট’নীতি মেনে এই খেলা চলে। মহাভারতে কথা এখানে তো মনে পড়বেই, মনের তো অনেক ‘উপায়’। আরও বেশি করে মনে পড়ে, যখন কবিতার শেষ দিকে যাইঃ ‘যেরূপে যুদ্ধের জয়/ অন্ধকারে ডাকে/ কাক, ঘেয়ো কাক, মৃত কাক, জাত কাক/ আকাঙ্খার ফোকরে ও ফাঁকে’। গুরু (মানি বা না মানি) আর শিষ্য (স্বীকার-অস্বীকার নিরপেক্ষ), দাতা ও গ্রহিতার মাঝে যখন কূটনীতি, যুদ্ধ, জয়-পরাজয় আর ছক সম্পর্কের দ্বন্দ্বে জেরবার, নীরব রক্তক্ষয়ী মল্লমাঠের ফোকরে ও ফাঁকে নানাজাতীয় কাকের আকাঙ্খা দৃশ্যমান। ...মৃদু উচ্চারণে এ এক সুতীব্র শ্লেষের কবিতা।
আরও একটি ভিন্ন-মেজাজ কবিতার সন্ধান পাই, ‘খাটাল’। শিল্প-হাহাকার বঙ্গের নিয়তি। এখানে ‘শিল্প’ মানে ‘ইন্ডাস্ট্রি’র কথা বলছি। ‘মোহিনীমিলের পাশে/ বন্ধ কারখানাটির পাশে/ মহিষেরা ডাকে/ গাই ও বাছুর ডাকে …’ । তার আগে পড়ে নিতে হয়, ‘গরম গরম ফেনা, দুগ্ধফেনা/ সবই জানা/ খড়বাছুরের জানা…’। এবং পরে উঠে আসে ‘মনুয়া যাদব রাখে, বাটে রাখে/ বিশ্বাস-অবিশ্বাস রাখে…’। এই মিত কথনে, নির্মল-নিরুত্তাপ কণ্ঠস্বরে ভাসিয়ে দেওয়া শব্দে, যে অঙ্গুলি-নির্দেশ, তা যেন অভিযুক্ত করে বুলি কপচানো রাজনীতির কারবারিদের। অথচ কোনও হল্লাবোল নেই। এখানেই কবি বিশিষ্ট। এই চখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া ছাড়া একজন কবি আর কতদূর যেতে পারেন। ‘আমিও রকমফেরে/ প্রশাখায়, শাখে/ দুলে দুলে দেখে যাই/ দুগ্ধপ্ররোচনা’।
বাজার। ‘আমাদের জ্বর/ কামনাকাঙ্খিত’। এই কয়েকটিমাত্র শব্দেই আমার কাছে ‘বাজার’ শব্দটি কিছুটা স্বচ্ছ মনে হয়। (এবং আমি দোলাচলেও ভুগি)। এই কবিতায় দেখি, ইঁদারার থেকে যা ওঠে তা কারও ‘ছায়াঘোর’। ইঁদারা কি অবচেতনের ইশারা? সেখান থেকে উঠে আসে বিশেষ কারও স্মৃতি? কামনাকাঙ্খিত …কি ‘প্রেমজ্বর’? … বিবিধ ঋতু ও সময়-কালে (‘সন্ধ্যা এল, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীতও ’) এই কামনা-ঘোর মিথ্যে ছায়ার মায়ায় পার করে ঋতুচক্র। কাল। ...আর সেই জলতলে ‘অতলান্ত পীত’ । আমি দোলাচলের কথাও বলছিলাম। সেই দোলাচলে ভাবি, বস্তুর কামনাও তো, তৃপ্ত না হলে, এই বস্তু-জগতের ভোগ-তাড়িত অর্থনীতি বিন্যাসে হতাশার জন্ম দেয়। পীত বর্ণ যৌবনের, জীবনের বিপরীত অর্থে যায়। ইঁদারার জল-সম্ভাবনা ও তার বাইরের স্থল-বাস্তবতা; মাঝখানের পীত আবহে কামনা-জর্জরিত দেহ পোড়ে। উঠে আসা ছায়াঘোর যেন তবু একজাতীয় অভিপ্রেত হাতছানি বলে মনে হয়।
‘গাজন’ কবিতাটা কোনও না কোনও ভাবে আমার ‘বাজার’ পাঠের সাথে কোথায় যেন ওতপ্রোত হয়ে যায়। “একটি চৈত্রের ঘোর/ যদি জল ভালোবাসে/ আমি তবে শ্বাসে ও প্রশ্বাসে/ ঘূর্ণিপথে উড়ি দেহমাখা ধুলো আর/ দেখ (দেহ?) ক্ষুধামাখা/ ঘোরে ঘোরে ঘনঘোরে/ বিজয়পতাকা।”
‘সাদা কালো লেখা’ শীর্ষকে এক, দুই, তিনটি পর্ব-বিভাজন। ‘দেহহীন দেহরস, রসে দেহ খাই’। ‘আমার চুম্বন ক্ষত দেহশস্যে যায়’। ‘মনের শরীরে জাগে/ শরীরের মন’। ‘তুমি শুধু মাংস কর, আমি ঘুমে যাই’। ‘অধিকন্তু দেখি আমি পক্ষীরূপ গ্রহ’। ‘চিহ্ন, গতি সমানুপাতিক/ রাতের পাখিরা...’। এই সমস্ত কথামালা আর মন্ত্রমুগ্ধ পাঠ, নবতর চর্যাপদ যেন, পার করে পাঠক। ভেসে থাকে মাথাময় ‘শূন্য গৃহ, শূন্য গেহ, শূন্য দেহযান/ যেখানে বসত করে শূন্যের আজান’। এটি এমন এক কবিতামালা, যার গভীরতা সীমাহীন। তত্বের গহন সুন্দর নির্মিত হয়েছে এখানে মানবাত্মার জীবদেহ ঘিরে কান্না ও নির্লিপ্তির অপরূপ বাঁধনে।
স্টেশন কবিতার লাইন ‘স্টেশনে স্টেশনে ঘুরি/ আমিও, শয়ান’ = সাদা কালো লেখার তিন নম্বর কবিতার ‘আমিও শয্যার মাঝে/ অগুন্তি অঘোর’ একাকার হয়ে যায়।
কবিতাগুলি মেদহীন, সুপ্রযুক্ত শব্দ-বাঁধনে ঋব্ধ। বহুমাত্রিক তাদের শরীর। ধ্বনির অব্যর্থ গহন কে ছুঁতে এই কবির বেশি ‘শব্দ’ লাগে না। কবিতা সাধনার নির্ভার, গহন মনোযোগ এইখানে অনুভূত হয়। বোধগম্য হয় মাত্রাজ্ঞানের গভীরতা। আত্মস্থ অভিজ্ঞতা।
অন্ত্যমিলের প্রতি আনুগত্য অনেক সময় কবিতাকে দুর্বল করে ও প্রসঙ্গান্তরে নিয়ে যায়। এই কবিতাগুলিতে সেরকমটি খুব বিরল ক্ষেত্রেই ঘটেছে। অন্ত্যমিলের পক্ষপাতিত্বে কবিতার বুনন যে তরল হয়নি তার কারণ কবির মুন্সিয়ানা আর গন্তব্যের অটলতা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন