রুমালচুরি- ৫



  

       কবির নাম, বয়স, লিঙ্গ, ঠিকানা ইত্যাদি যা কিছু কবিতার জন্য জরুরি নয়, তা আমরা মুছে দিয়েছি। আর এভাবেই ১০টি কবিতা পাঠানো হয়েছে অন্য এক কবির কাছে- আলোচনার জন্য। শুধু ১০টি কবিতা, আগে পরে নাথিং। আমাদের সাথে রুমালচুরির এই খেলা খেললেন ১৯ জন কবি।

       এখানেও কবির নাম ছাড়া ১০টি কবিতা রাখা হল, সঙ্গে থাকলো আলোচনা। কবির নাম জানার রাস্তা কবিতার নীচ দিয়ে গেছে। তবে আমরা বলবো রুমালচুরির এই খেলায় আপনিও থাকুন। কবির নামটা না হয় একটু পরেই জানলেন।




  ১০টি কবিতা

   ডাক

   পাঠাবার মতো ডাক পাঠিও আমাকে
   যে ডাকে জীবন এসে চিঠি দিয়ে যায়

   উঁহু, কোনো কুহু নয়, একটি কর্কশ কেকা যথেষ্ট হবে
   যেন আশরীর চমকে উঠে পেচ্ছাপ বন্ধ হয়ে যায়
   এই যে সাজিয়ে রাখছি এক ঘরময় আশ্রয়হীনতা
   করপুট গলে একটু কী মন বাইরে আসছে দেখে ভাবি সূর্যালোক হলো
   প্রকৃত গাছের কিন্তু অন্ধকার নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই
   এই যে সাজিয়ে রাখছি নিজেকে শো-পিস্‌ সারা যাতায়াতময়
   অথচ রাস্তার কোনো ছুটি নেই ঘরে ফেরা নেই

   তোমাকে অন্তিম ভাবি, ইচ্ছেতে রাখো
   যেন অন্যভূমি থেকে ফিরে আসে আমার শরিক
   আচমকা ময়ূর দেখে ক্যালেন্ডার উলটে পালটে যায়

   তেমন ডাকের চিঠি শুনিও শুনিও


   লেখা

   খুঁজতে খুঁজতে যার ক্রমাগত ছন্দ হারিয়েছে
   উল্টোপাল্টা হাওয়া, তাতে সুর লয় কিচ্ছু ছিলো না
   হঠাৎ কী দ্রুত ফুল পাথরের মধ্যে দ্রুত মিলিয়ে গিয়েছে
   আবার দেখার ঘোরে, এবার পাহাড় ভেঙে পশ্চিম পশ্চিম
   হারিয়ে যাওয়ার এই মৃদুবর্ণ
   ক্রমশ চ্যুতির দিকে বেঁকে যাওয়া স্বজনসন্ধান
   ক্রমশ পাথর আরো পাথর বাড়ায়
   উল্টোপাল্টা হাওয়া আরো উল্টোপাল্টা সময়ের পাপড়ি এনে দেয়
   সে ফুল দুরূহফুল, তাকে ক্রমে অদর্শনফুল বলা যায়
   যে যায় খুঁজতে তার চলাচলে সন্ধ্যা ফুটে যায়
   তাকে দেখা যায় না, ধরা যায় না
   শুধু, কাছে এলে টের পাওয়া যায় যে, সে
   লেখা


   আশা

   শেষ করা তেমন কোনো কাজই নয়
   আপ্তবাক্যের জঙ্গল ফুঁড়ে এই যে আসছো নতুন বিদ্যুৎ, একে বলে আশা।
   উল্টোপাল্টা কথায় পড়ে নভেম্বরের রোদ
   কুবাক্য ও বিষের প্রতি স্মাইলি ছুঁড়ে দেয়
   হৃদয়ের জন্তুগুলি কথায় কথায় ঘুরে মরে
   মেয়াদ ফুরনো ওষুধ তাদের কোন্‌ কাজে লাগবে বলো তো?
   এক্ষুণি তো জেগে উঠবে খুনী ডিসেম্বর, তার হাসিরাশি টোপ
   রোগা রোগা মানুষেরা এই ভেবে ফন্দী নাচায়
   স্টেশনরোডের কাছে দু-তিন কাঠা জমি কিনে রাখে

   চিঠিতে যে এই এখনও পুনশ্চ রেখেছো, একে বলে আশা।


   পদ্য

  তেমন নেশার ঘোরে শরীরে শ্রমণ এসে যান

  কে আমাকে ধরবে, আমি প্রশ্নে প্রশ্নে ঘুরে মধু খাই
  উড়ে বসি জুড়ে বসি, বৃষ্টিবাদলা ডেকে আনি

  আমাকে কে ধরবে, আমি শিস দিয়ে রোদ নিয়ে আসি
  রোদেই সওয়ার হয়ে শত্রুমিত্র পার হয়ে যাই


  কে ধরবে আমাকে, এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশে আমি রাগপ্রধান
  বাতাস আমার শিক্ষয়িত্রী, যে কোনো প্রসঙ্গ ধরে টানি

  আমাকে ধরিবে কেডা, আমি এই পদ্যটি যে শেষই করি না


  প্রাণ

  অযথা রোমাঞ্চ বলে ভাবি। বাড়ি ফেরার পথে কেউ নভেম্বর সাজিয়ে রাখেনি।
  বেশি করে ভাবলে শুধু দেখা যায় কম কথার বাগান। ফাঁকা পড়ে রাগের ঈশ্বর।
  এই আসে, চলে যায় মরশুমি ফুলের আবহ। আমিও বিক্ষুব্ধ প্রাণ উড়ু উড়ু তারে মেলে দিই
  আনন্দ নেবো না, শুধু আমি চাই ধুন্ধুমার শুরুর বাঁশিটি


  পোকাদের কথা

  ১.

  এই জার্নির আশেপাশে অস্পষ্ট ফসলের মাঠ। আর দেহপরিধিতে
  মনখারাপ রঙের পশম। এইসব নিয়েই চলেছি।
  এক একটি জনপদ ফুটে ওঠে সন্দেহের মতো।
  যেন ললিত রাগের টানে কিছু কিছু জোনাকি এসেছে।

  তো, আবিষ্কার করি, এই মনখারাপ হলো এক প্রয়োজনীয় ফল।
  তা থেকে রসটি নিয়ে বেঁচে থাকে আমাদের পোকা

  ২.

  আমাদের পোকাগুলি নড়ে ওঠে। মাথাতেও ওঠে।
  এমনকি স্বপ্নের মধ্যে তাহাদের শুঁড়গুলি হেসেখেলে যায়
  আমাদের পোকাগুলি সময়মতো হারিয়ে যেতেও পারে

  তো, রক্ষে এই, আমাদের মাঝখানে অসম্ভবের সেতু।
  আর বেশ কয়েক মানুষ দৈর্ঘ্যমাপ। এই যা রক্ষে

  ৩.

  আমাদের পোকাগুলি চরিত্রকে কুরে কুরে খায়।
  আমরা ভাবি, দুর্ভাবনায় মানুষটা রোগা হয়ে গেছে !
  ভাবনায় পোকাদের নীরব অট্টহাসি ওড়ে

  এইভাবে, কোনোভাবে, লেখাকে শেষের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি, দেখে
  পোকাগুলি মৃদু মৃদু পথ করে দেয়

  ৪.

  এই পোকাদের নাম কী দি’, যেমন কাফকা নাম নিয়েছে সে জাপানি ছেলেটি
  নির্দিষ্ট একটি নয়, এই পোকাগুলি পিলপিল শ্রেণির
  ধ্বনি ও ভারসাম্য নিয়ে, শব্দের বুনন নিয়ে উহাদের মাথাব্যথা আছে

  তো, এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশে, আমাকে উদ্ধার করে পোকারাই
  ‘যে নামেই ডাকো, তুমি আবহাওয়া বদলাতে পারবে না

  ৫.

  পোকাদের যুক্তিগুলি আমাকে সন্ত্রস্ত করে দেয়
  ভরাবাজারের মধ্যে দড়ি ধরে টান মারবে, এরকম কথাই ছিল না
  যে পোকা আমার, সেই পোকা কি গো আমাদেরও নয়?

  তো, শুধু বুড়বুড়ি ওঠে জলে, লোকালয় ফাঁকা হয়ে যায়
  আমার ও পোকার মধ্যে এরকম যুদ্ধের কথাও ছিল না

  ৬.
  আমাদের পোকাগুলি আমাদের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা ভূগোল পার হয়
  কে কার মাথায় চড়ে, দ্বন্দ্ব দেখে ধাঁধা লেগে যায়
  অনুপ্রাসের দিনে অথচ তো সকলেই একত্রে বেজেছে

  হঠাৎ হাওয়ার ঝোঁকে নেইহয়ে যাওয়া আর আমাকে মানায়?
  বরং স্নায়ুর পথ খুলে দিই, ঘুরে ঘুরে প্রাণে এসো পোকা





  কবিতার পোকাদের কথাঃ কবিঃ পুনঃসৃজন
আলোচনা করলেন উমাপদ কর  

       বেশ কয়েকবার পড়লাম কবিতাগুলোবেশ কয়েকবারকেন যে এতোবার করে পড়তে গেলাম! আমি কি কিছু খুঁজছিগরু হারিয়ে গেলে যেমন গেরস্ত খোঁজেআংটি হারিয়ে ফেলে নব-বধূটি যেমন আতিপাতি করে বিছানা বালিশ কিংবা স্নানঘরআমার তো কিছু হারায়নি, তবু আমি কী খুঁজছি? আমার হারায়নি, আমাকে দেওয়া হয়েছে কয়েকটি কবিতাঅর্থাৎ হারানোর বদলে পাওয়ামানে দাঁড়ালো পাওয়ার মধ্যে খোঁজ়াআমি এখন কবিতার মধ্যে কবিতা খুঁজে ফিরছি

       আমি কি কিছু বুঝতে চাইছি? তার জন্য বারবার পড়ার আপ্রাণআমি কি কোনো প্রতিপাদ্যতায় পৌঁছুনোর চেষ্টায় আছি? যার জন্য ঘুরে ফিরে বিভিন্ন সময়ে আবার পাঠ জরুরি হয়ে পড়ছে আমারএ আমার কী হলো, প্রথম লাইনটাই যে লিখে উঠতে পারছি নাআর কবিতায় আমি কী বুঝব, কোন প্রতিপাদ্যতার দিকে এগুবো? কবিতায় বোঝার আর প্রতিপাদ্যতার কি কিছু আছে, থাকে? আমার যে বিশ্বাস, না কবিতা বোঝার নয়, নিং নিং করে বাজারআমার যে মত প্রতিপাদ্যতা নয়, একটা অনুভবের দ্বারের কাছে এসে দাঁড়ানো, একটা বোধের মহিমায় স্পার্ক করে যাওয়া, একটা চেতনার মুখোমুখি এসে মিলিয়ে দেখার প্রয়াস

       তো তাই জারি থাকুকনাই বা জানলাম শিল্পীর নামতাঁর শিল্পকর্মটি আমার চোখের সামনেতাঁর সৃষ্টি আর নির্মাণে আমার অবাধ গমনে কোনো বাধা নেইশুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট, যে আমি কীভাবে পড়লাম আর পুনঃসৃজন করলাম কবিতাগুলোকেডাককবিতার প্রথম দুটি চরণই ধরা যাক নাপাঠাবার মতো ডাক পাঠিও আমাকে / যে ডাকে জীবন এসে চিঠি দিয়ে যায়আবার শেষ পঙক্তিটা এমনতেমন ডাকের চিঠি শুনিও শুনিওঅর্থাৎ দাঁড়ালো কবিতার নামডাক’, প্রথম লাইনে একটি বিশেষডাকপাঠানোর অনুরোধ, আবার শেষ লাইনেওডাকপড়ে শোনানোর সনির্বদ্ধ অনুরোধআর মাঝখানে কেমন ধারারডাকতার বিমূর্তিকরণসুতরাং আমি চাই বা না চাইডাককেন্দ্রিকতার মধ্যে আমার পুনঃসৃজন ঘুরে ফিরে বেড়ায়কিন্তু একইসঙ্গে এই কেন্দ্রিকতা ভেঙে ফেলারও একটা প্রয়াস আছেমাঝখানের ব্যাখ্যানেশুধু ফিরে এসে ডাক’-এর বৃত্তটিকে একটা পূর্ণতা দেবার চেষ্টা আছেআর আমি কিভাবে পড়ি? ‘ডাক পাঠিও/ যে ডাক জীবন এসে দিয়ে যায়কবি ঘরময় সাজিয়ে রাখেন আশ্রয়হীনতাআমিও সাজাইএই বৈপরীত্য ডাক কেন্দ্রিকতা ছাড়ানো, কিন্তু একটা অন্তর্সূত্র রয়েছেকবি মনে করেনপ্রকৃত গাছের কিন্তু অন্ধকার নিয়ে কোনো অভিযোগ নেইআমি তা মনে করি নাশুধু অন্ধকারে সালোকসংশ্লেষ সম্ভব নয়বাঁচবে না সেবাঁচার রসদ না থাকলে অভিযোগ জানাবে না সে? যতই সহিষ্ণু হোককবি ভাবেনঅথচ রাস্তার কোনো ছুটি নেই ঘরে ফেরা নেইআমিও তাই ভাবিরাস্তা ঘরে ফেরে নাকবি অনুভব করেন, “আচমকা ময়ূর দেখে ক্যালেন্ডার উলটে পালটে যায়। আচমকা-টা উঠিয়ে দিলে আমিও অনুভব করি তেমনিআর মনে হয় সত্যি একটা চিঠি পড়ে শোনানোর সময় হলো তখনতো এইভাবে কখনো সমলয়ে ভেসে কখনো আড়াআড়ি চিন্তা নিয়ে কবিতাটি আমাকে জাগিয়ে রাখে, কোনো প্রতিপাদ্যতার দিকে না ছুটে অভিনিবেশ দাবী করে

       ‘লেখাকবিতাটি একটা সরলবর্গীয় গাছের মতনছন্দহারা, সুর-লয় উল্টোপাল্টা, নিমেষে হারিয়ে যাওয়া ফুল পাথরেসে দুরূহ ফুল, দেখা যায় না, বোঝা যায় নাশুধু কাছে এলে বোঝা যায় সে আসলে একটি লেখাএকটা রূপকের আড়ালে রাখা কবিতাএকরৈখিকও বলা যায়দু-একটি পঙক্তিতে চমক আছেযেমন, “হারিয়ে যাওয়ার এই মৃদুবর্ণ / ক্রমশ চ্যুতির দিকে বেঁকে যাওয়া স্বজনসন্ধানকবিতা কি কিছু কম পড়িয়াছেমনে হয়, মনে হয়আমার পুনঃসৃজন স্পৃহা কোথায় যেন টাল খেয়ে যায়
  
       ‘আশায় ফের আশা সঞ্চারশেষ পঙক্তিটি এমন—“চিঠিতে যে এই এখনও পুনশ্চ রেখেছো, একে বলে আশা।একটি পঙক্তিই একটি কবিতাতবে কি বাকি পঙক্তিগুলির কোনো প্রয়োজন ছিল নাকিন্তু বিষয়টা তা নয়ওই পঙক্তিটি উঠে আসার মুখবন্ধ হিসেবে গোটাটাই একটা কবিতাকবিতার দ্বিতীয় পঙক্তিতে লেখা হয়েছিল— “আপ্তবাক্যের জঙ্গল ফুঁড়ে এই যে আসছো নতুন বিদ্যুৎ, একে বলে আশা।অর্থাৎ আগেই তাকে চিহ্নিত করা হয়েছেঠিক সংজ্ঞা নয়, কবিতা করে আশাকে চিহ্নিত করামাঝে আছে একটা মোচড়, যা অনেকটা অবধারিত নয় তবু এসেছে, এবং কবিতায় নতুন মাত্রা জুড়েছেসেও আশার মোড়কেইযেমন— “রোগা রোগা মানুষেরা এই ভেবে ফন্দী নাচায় / স্টেশনরোডের কাছে দু-তিন কাঠা জমি কিনে রাখেজমি কিনে রাখা তো আশারই নামান্তরআর সব মিলিয়ে একটা আপাত পূর্ণতার দিকে যায়কবিতাটির সঙ্গে সমমেলে বেজে উঠি, বা সমান্তরালে সৃজন করি নিজস্ব ভাষ্যদুয়ে মিলে একটা স্পার্ক, যা কবিতাটির প্রাণ হয়ে আমার প্রাণে বাজেসাধু

       ‘পদ্যএকটি কবিতার নামনাম বিশেষকিন্তু পদ্য (Verse) এবং কবিতার (Poetry)মধ্যে পার্থক্য কবি জানেনতাই শেষাবধিপদ্যও একটি কবিতা হয়েই দাঁড়ায়কবিতাটি শেষ করা হচ্ছে এইভাবে—“আমাকে ধরিবে কেডা, আমি এই পদ্যটি যে শেষই করি নাকবি পদ্যটি শেষই করেন নাঅর্থাৎ একটি সম্ভাবনার দরজা তিনি খুলে রাখতে চানযাতে ভ্রমণ জারি থাকেকে আমাকে ধরবেদিয়ে দুটো স্তবকে প্রশ্নটি তুলে তার মতো করে তিনি কবিতা সাজিয়েছেনকিন্তু শেষ পঙক্তিতে তিনিকেডাএই দিশি শব্দটি ব্যবহার করে কী করতে চেয়েছেন তা আমার বোধের অগম্য রয়েছেবরং এই হঠাৎ করে এই ধরণের ব্যবহার কবিতাটিকে আদৌ শ্রুতিমধুর করেনি বলেই আমার মনে হয়েছেআর মনে হয়েছে একটু বেশিই সরল সিধে এই বাচনিক

       ‘প্রাণকবিতার প্রাণ-ভোমরাটিকে আবিষ্কার করতে গিয়ে আমার রোমাঞ্চ হলোএকটা স্পার্ক খেলে গেল, যখন পড়লাম, ‘বাড়ি ফেরার পথে কেউ নভেম্বর সাজিয়ে রাখেনি।-তো অভিজ্ঞতাকোনো বিশেষ দর্শন বা লক্ষণ নয়অথচ কবির মনে হয়অযথা রোমাঞ্চতবে কি পাঠকের (আমার মতো) ভাবনার সুতোটি আড়াআড়ি প্যাঁচ কষছে কবির ভাবনা সুতোটির সঙ্গে? হতে তো পারেইএই আড়াআড়ি থেকে সমান্তরালে যাওয়া আবার সমান্তরাল থেকে লম্বে অবস্থান, এক যাতায়াতএক ভ্রমণযা করতে রাজী কবি এবং পাঠকএবং এভাবেই কখনো এক বিন্দুতে এসেও ছিটকে যাওয়াআর নানা-রকমের সম্ভাবনার দরজা খুলতে খুলতে যাওয়া এবং আসাবিক্ষুব্ধ হয়েওধুন্দুমার শুরুর বাঁশিটিচাইতে কবি ভুল করেন নাকারণ সেই বাঁশিটির মধ্যে লুকিয়ে আছে যাপন তথা এই কবিতার প্রাণ-ভোমরাটিসমান্তরাল ভাবনায় এবারে কবি এবং পাঠক একাত্ম হতে থাকেপাঠক হিসেবে একটা স্পার্ক তার মধ্যের কবিতাটিকে উস্কে দেয়

       ‘পোকাদের কথাআমাকে টেনেছে বেশিছিমছাম ছটিবাড়তি গতি কিছু নেইহালকা-পুলকা চলনবেশি করে বলে ফেলা নেইগভীর কোনো জীবন-বেদ নয়আবার যথেষ্ট স্মার্ট অথচ আড়াল-পছন্দকারীকথাগুলো পোকাদেরকিন্তু সে পোকা প্রায় সবক্ষেত্রেইআমাদের পোকাএকবার একটি প্রশ্ন উঠেছেআমার পোকা কি আমাদেরও নয়? বলা বাহুল্য উত্তরটি হ্যাঁ-বাচকইযদিও প্রশ্নের উত্তর কবি দেন নিকিন্তু কবিতার ঢং এবং বাচনিক প্রশ্নের মধ্যেই হ্যাঁ-টি পুরে রেখেছেনদেখা যাচ্ছে পোকাগুলো সর্বজনীন একটা রূপ নিচ্ছে, তাদেরও একটা যাপনের তরিকা আছেআর আছে পোকাদের এক নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিএকটু খেয়াল করা যাকআমাদের মনখারাপের বিষাদ-ফলের রস খেয়ে পোকারা বেঁচে থাকেপ্রায়ই পোকাগুলো থাকে মাথায়এমনকি আমাদের স্বপ্নের মধ্যেও ওদের সহাবস্থানআমাদের পোকাগুলি আমাদের কুরে কুরে যেমন খায় তেমনি আমাদের অগ্রসর হওয়ার পথটিও করে দেয় অনেকটা বিবেচকের মতোএকদিকে পোকারা যেমন কোনো গড্ডল থেকে উদ্ধারকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়, তেমনি কথা না থাকলেও যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়এই রকম আচরণশীল পোকাদের বার বার ফিরে ফিরে আমাদের ডাকতেও হয়, যেন আমাদের মধ্যেই সে তার বসতকে দীর্ঘস্থায়ী করেএতসব বলার পর আর এই পোকাদের নামকরণ নিয়ে পাঠকের আর কোনো দ্বিধা বা সংশয় থাকে না যে এই পিলপিলে শ্রেণির পোকারাকবিতার পোকাসে কবি তাদের যে নামেই চিহ্নিত করুন না কেন! আসলে এই পোকাদের দৌরাত্ম্যে, সুড়সুড়িতে, উৎপাতে আর প্রশ্রয়ে যে আবেগ যে ড্রাইভ যে অভিঘাত তাই দিয়েই সৃষ্টি আর নির্মাণএই পোকাই আমাদের মধ্যে ভ্রমণশীল, কখনো যুক্তিতে সন্ত্রস্ত করে, কখনো প্রশ্রয়ে এগোবার মিহি পথ করে দেয়এই পোকাই আমাদের মধ্যে সৃষ্টিশীলকখনো মস্তিষ্কে ক্ষরণ ঘটিয়ে কখনো গোটা শরীরে আলোড়ন ঘটিয়ে সে আমাদের চিন্তার খোরাক যোগায়এই পোকাই আমাদের মধ্যে নির্মাণধর্মীকখনো আহরিত শব্দের বুনন নিয়ে, কখনো ধ্বনি ও ভারসাম্যের বাতাবরণ নিয়ে সে আমাদের সচেতক হতে নির্দেশ দেয়আবার কখনো অদম্য চাপকে রিলিজ করতে খুবই আন্তরিকভাবে পথ করে দেয় সুগমহয় সৃষ্টি, হয় নির্মাণকবিতায় কবিতা-পোকাদের জয়ধ্বনি শোনা যায়এই কবিতাগুলো পড়তে পড়তে আমার মধ্যেও কবিতার পোকাগুলো কিলবিল করে নড়ে উঠছে আমি টের পাচ্ছি, অনুভব করছিকবিতার কাছে এরচেয়ে বেশি আর কী চাইতে পারি? একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, পোকাগুলো কি কোনো রূপককে রেফার করল? হয়ত করেছেকিন্তু তাতে কবিতার কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি



       এভাবেই আমার কবিতাগুলোতে গমন। একজন পাঠক হিসেবে আমার মাধ্যমে পুনঃসৃজিত হলো এইসব কবিতারা। এক ধরণের আনন্দানুভূতিতে সমুজ্জ্বল হলাম আমি। আর যেটুকুতে সেভাবে আলোকিত হতে পারলাম না, তাও হয়ত আমারই খামতিহয়ত অন্য কেউ সমলয়ে বেজে উঠবেন, এটুকু প্রত্যাশা তো করতেই পারি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন