
কবির নাম, বয়স, লিঙ্গ, ঠিকানা ইত্যাদি যা কিছু কবিতার জন্য জরুরি নয়, তা আমরা মুছে দিয়েছি। আর এভাবেই ১০টি কবিতা পাঠানো হয়েছে অন্য এক কবির কাছে- আলোচনার জন্য। শুধু ১০টি কবিতা, আগে পরে নাথিং। আমাদের সাথে রুমালচুরির এই খেলা খেললেন ১৯ জন কবি।
এখানেও কবির নাম ছাড়া ১০টি কবিতা রাখা হল, সঙ্গে থাকলো আলোচনা। কবির নাম জানার রাস্তা কবিতার নীচ দিয়ে গেছে। তবে আমরা বলবো রুমালচুরির এই খেলায় আপনিও থাকুন। কবির নামটা না হয় একটু পরেই জানলেন।
১০টি কবিতা
মাছঘর
অব্যাহতির
অবশেষ ডানায় জলপাখিটি বসে। রাত্রিপথে বিষাদ দুঃখ জানলা খোলো। গুহা অবকাশে মেঘাতুর
স্টেশন,
কাকভোরের পাশে দীর্ঘ আঙুল।
এলাচ
গাছটি গাথাকোরাসে বিছানা বদল করে।
কলতলা
চুপচাপ আরও নিবিড় মাঝেমাঝে
আক্রোশে
বসে পড়ার ভেতর আড়ালের কথা—
বন্ধনী
শুকিয়ে যায়; কলতলা জুড়ে
আমার মৃত্যু দেখা যাচ্ছে।
প্রেক্ষাপটের পর
আপ্লুত
ঘুম
পুরনো
অপেরার নোটেশন ছায়া ফেলছে
স্কোরবোর্ডে
ছুটিয়ে দেব জলযান—
হৃদযন্ত্রে
দস্তানা ফেলে যান ঈশ্বর
আত্মমৃত্যুর পরিসর ৩
হঠকারি
হাত আমি দেখে ফেলেছি বাগানে জান্তব ডুব
নাভিশ্বাস
ছলকে ওঠে পিচ ঢালার মেজাজে।
পারদের
নিচে ঘুণপোকার কেঅস
আত্মমৃত্যুর পরিসর ৬
তবুও
সাঁতার যেটুকু আছে আর কাঠের বারান্দায় ঝোলানো পোশাক
রিমোট
ডুবিয়ে দাও সচেতন জামার নিসর্গে
শিশি
বোতল গড়িয়ে যাক। হেসে ওঠো ভৈরোঁ
চাকার
পেছনে ঝলসানো আসবাব—
এস্কেলেটর
স্থির
আলো, নিরবচ্ছিন্নভাবে টাঙিয়ে দাও
যতদূর
স্টীমার ঘাট।
শাদা
আরামকেদারার কাছাকাছি মীরকাশিমের গল্প।
ব্যাপক
ঘুমের পাশে আলিঙ্গন করতে করতে যেন অনিবার্য
এস্কেলেটর
পেয়ে যাই।
হাইফেন
স্বপ্নতাড়িত
শব্দের দিকে মৌমাছি। টুকরো টুকরো সমাহার।
পাতা পড়ছে
টেবিলের
ওপর রাখি পরিত্রাণ শব্দটিকে।
একটি প্রাগৈতিহাসিক নাটক
ছড়িয়ে
ছড়িয়ে দেওয়া আলোর কুচি থেকে প্রাগৈতিহাসিক
আরো
দুজন কেন্দ্রবিন্দুর ভাষায় শেষ সংলাপ বলে নিচ্ছে।
‘অদ্ভুত ডাকনামের পাশে গজিয়ে ওঠা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
পানভোজনে
আরো কিছুটা সবুজ হোক।’
আমরা
মেষপালকের হেলমেটটি কুড়িয়ে আনতে যাচ্ছি।
পাথর
গড়াও। ভ্রাম্যমান বিশেষ্যপদের বাঁ দিকে
জ্যোৎস্না... সমুদ্রমাছ আর
হেঁটে বেড়ানো অলৌকিক
ফিডিং
বোতল।
কথা হচ্ছিল শূন্যস্থান পূরণ নিয়ে
শব্দ
জড়িয়ে থাকে ঘুম। অজস্র হেঁটে বেড়ানোর তথ্যচিত্র।
মৌমাছির
পালক থেকে খসে পড়ছে জাদু ও পেন্সিল। তবু
সকাল
সকাল বীজকথা। ধ্বস্তলিপি। মেঘপুরাণ।
আর এক-শিংওয়ালা
ঘোড়া।
এগিয়ে
আসে। থপথপ। কাদা পা।
গর্তের
ভেতর লুকনো গুহাবাসীদের খসড়া।
প্রচুর
জন্মের ভেতর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছি পর্দার ওপাশে।
যেন
স্যুইচ অফ আর স্যুইচ অনের মাঝখানে যতটুকু গ্যাপ
তার
মধ্যে একটা ইউনিকর্ণ নিয়ে বসে আছি
নোটা বেনে
শোকসমেত
রোমকূপে এবার বিরতি। নিচু হয়ে থাকা
অশৌচ
জঙ্ঘায় সংক্রামিত অনুভূমিক সন্ধেগুলো।
যেন
ঝুরঝুর আলপিন অনায়াসে শিখে গেছে
অশ্রুডানা,
অজস্র হেঁটে বেড়ানোর তথ্যচিত্র
আলোচনা করলেন বিভাস রায়চৌধুরী
কবিতার বাস্তবে অবাস্তব
মিশে থাকে। আবার কবিতার অবাস্তবে মিশে থাকে বাস্তব। এখানে গৌণ কেউ নয়। বাণীও থাকে।
বাণী মুছে দেওয়ার জলন্যাকড়াও থাকে। 'মাছঘর' কবিতায় জলপাখির বসে
থাকাটা বড় চেনা। রাত্রি, বিষাদ, দুঃখও।
কিন্তু কাকভোরের পাশে 'দীর্ঘ আঙুল'টি
কবি এঁকেছেন। এলাচ গাছটিও কবি জীবনের।
এই কবিতাগুচ্ছটি
চলচ্চিত্র হিসাবে দেখছি। খুব একটা নিঝুম ভাব। একাকীত্বের খেলা। 'চুপচাপ/আরও নিবিড়'। সত্তা নিয়ে নিবিড় ভাবনা
মৃত্যুচেতনার দিকে যাবেই।
'কলতলা জুড়ে
আমার মৃত্যু
দেখা যাচ্ছে'।
এই কলতলা গ্রাম-মফস্বলের। কখনও ভিজে থাকে, কখনও ধু ধু। কবির
বিচরণভূমি এভাবেই কবিতায় ধরা থাকে। 'অপেরা', 'নোটেশন' বেমানান লাগে। বিদেশি কবিতার অনুবাদ মতো
লাগে। আকুলতা আর আত্মজীবন পাশাপাশি প্রার্থনীয়। 'বাগানে
জান্তব ডুব' ভাল লাগে। কবির তো ডুবুরি-ধর্ম। পোশাক, সচেতন জামা তো বাইরের খেলা। 'আত্মমৃত্যুর পরিসর'-এ সেসব বিসর্জন দিয়ে সাঁতারের কাছে যেতে হয়। সাধনা। পরের কবিতায় 'মীরকাশিমের গল্প' কবিকে আবার চিহ্নিত করে। অবচেতনের
গভীরে কে যে কখন জায়গা পেয়ে যায়। ঘুম এখানে ঘুমঘোর। এই পর্যায়ে মুখস্থ হয়ে যায় 'হাইফেন' কবিতাটি। কবি যে অবিরাম বসত করেন কবিতা
নির্মাণ প্রক্রিয়ার ভেতর, তারই নিমগ্ন ছবি -
"স্বপ্নতারিত
শব্দের দিকে মৌমাছি। টুকরো টুকরো সমাহার।
পাতা পড়ছে
টেবিলের ওপর রাখি
পরিত্রাণ শব্দটিকে।"
পরিত্রাণের পরেই পেয়ে যাই
'মেষপালকের
হেলমেট'। যেন শব্দের উত্তর-আধুনিক ছবি। বিশ্রী অস্থিরতাও এই
কবিতাগুচ্ছে ঘুম-ঘুম রঙে ছোপানো। "শব্দ জড়িয়ে থাকে ঘুম। অজস্র হেঁটে বেড়ানোর
তথ্যচিত্র।/ মৌমাছির পালক থেকে খসে পড়ছে জাদু ও পেন্সিল"। জাদু একটা আছে একথা ঠিক।
দশটি কবিতাতেই আছে জাদুবাস্তবতা। প্রচুর জন্মের দৃশ্য। ভাষা ভেঙে ভেঙে অতর্কিত
দিয়ে লেখা। 'প্রবল আমলকির সমূহ শীতকাল' -এর 'সমূহ' শব্দটিই মৌমাছির গুঞ্জন। দশটি কবিতা তৈরি
করেছে ইশারাপ্রবাহ। হৃদয়ের থেকে একটু দূরে কবির গন্তব্য? না
কি দৃশ্যে না রেখে তাকে অদৃশ্যে রাখা আছে? আরও গভীরে কান
পাতি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন