
কবির নাম, বয়স, লিঙ্গ, ঠিকানা ইত্যাদি যা কিছু কবিতার জন্য জরুরি নয়, তা আমরা মুছে দিয়েছি। আর এভাবেই ১০টি কবিতা পাঠানো হয়েছে অন্য এক কবির কাছে- আলোচনার জন্য। শুধু ১০টি কবিতা, আগে পরে নাথিং। আমাদের সাথে রুমালচুরির এই খেলা খেললেন ১৯ জন কবি।
এখানেও কবির নাম ছাড়া ১০টি কবিতা রাখা হল, সঙ্গে থাকলো আলোচনা। কবির নাম জানার রাস্তা কবিতার নীচ দিয়ে গেছে। তবে আমরা বলবো রুমালচুরির এই খেলায় আপনিও থাকুন। কবির নামটা না হয় একটু পরেই জানলেন।
১০টি কবিতা
পাগলের মতো ঘন্টা বাজছে চরাচরে
বিদায় বলতে বিষন্ন লাগছে... মনে হচ্ছে আর একবার
ঘুমোই...
ভয় করছে আমার,
খুব ভয় করছে, আর লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয় গাছের শিকড়ে, যখন মানুষের ঘিলু থেকে বেরোচ্ছে বারুদের ধোঁয়া, যখন লাল হয়ে যাচ্ছে সবুজ শান্ত মফসসল, বিকট চিৎকার করছে শুকিয়ে যাওয়া নদীর মতো আমাদের মা, আমার অবাক লাগে একজন সাংবাদিকও মরছে না, একজন নেতাও না, পণ্ডিতেরা টিকি নেড়ে ভাগ হয়ে যাচ্ছে দু' পক্ষে, অথচ মরছে কেবলই মরছে অগুনতি ধানগাছ, গাংশালিখ, বোবা হয়ে যাচ্ছে বুলবুলি, কে জানে গণতন্ত্র কীরকম? সে কি এক ফোকলা স্বৈরাচারী? সে কি এক উচ্চাকাঙক্ষী পাগল মনসা? আজ ট্রেন বাস থেমে গেল কলকাতায়, খুব ভয় করছে,
ভয় করছে আমার, আঃ নেটওয়ার্ক ব্যস্ত
থাকায় মেয়েকে ধরতে পারছিনা ফোনে, আটটা পাঁচ বাতিল... ন'টা দুই বাতিল... ন'টা তিরিশ বাতিল... শিয়ালদহ বন্দরে ঘরে ফিরতে চাওয়া মানুষের ভিড় ক্রমশই বাড়ছে, হু হু হাওয়া এল, উড়ে যাচ্ছি দু'-একটা মানুষ শূন্যে, আপাতত বনগাঁয় কোনও গণ্ডগোল নেই, কিন্তু ওখানেও তো লাখো লাখো ধানগাছ, তার অরক্ষিত আলে কোনও রোববার আমি আর মেয়ে গিয়ে দাঁড়াব কথা আছে,
কোথাও রক্ত নেই, তবু সাদা ফ্রকের প্রান্ত বুলিয়ে আমার ছোট্ট মেয়ে ধানগাছের পাতা মুছিয়ে দেবে কত যত্ন ক'রে, আমার হাসি পাবে,
কান্না পাবে,
আমিও হাঁটু গেড়ে বসব মাটির ওপর, আলের ঘাস থেকে তুলে নেব শিশির, চোখের পাতায় বুলোব, কে কার অশ্রু আর চেনাই যাবে না, আর আজ নিয়তিতাড়িত কোনও ট্রেনে গাদাগাদি হয়ে বাড়ি ফেরার পথে দেখতে পাব কালো পুলিশের গাড়িটাকে তাড়া করেছে এক লাল দমকল, পাগলের মতো ঘন্টা বাজছে চরাচরে, ওরা কোন জাহান্নামে যাবে জানি না,
তার আগেই আমাকে পৌঁছে যেতে হবে মৃত নদীর গর্ভে...
বাকি রাতটুকু আমি বালি খুঁড়ব, বালি খুঁড়ব, মেয়ে ঝুঁকে পড়ে বলবে, জল...
খরা
আর কী তোমাকে লিখব? মনখারাপের ভেতর
অতলান্ত বেদনার ভেতর
বেজে ওঠে যে-প্রান্তর,
তার নাম জীবন...
জীবন! জীবন!- বলে আমি দৌড়াতে দৌড়াতে
এক গ্ৰামের কাছে পৌঁছেছি।
কখনও মৃত নলকূপ দেখেছ তুমি?
পরিত্যক্ত, একা, প্রেতের মতো?
মনে হবে যেন কোনও সম্ভাবনা
চিরতরে চলে গেছে আমাদের ছেড়ে!
এও মনে হতে পারে, ওই তো কবিদের প্রেমিকা...
ওর জন্যই তরুণ কবির কবিতায় গুমরে উঠছে চিরকাল
রক্তমাখা হৃদয়...
আমি এক কাণ্ড করলাম।
জানি পৃথিবীটা বুড়ো কবিদের জায়গা নয়,
তবু জরাজীর্ণ পুরনো কৃষকের মতো আমি মৃত নলকূপ
জড়িয়ে ধরে
আজ চিৎকার করে কাঁদলাম...
তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলাম...
তারপর স্তব্ধতায় জড়াজড়ি করে রইলাম দু'জনে...
আর কী তোমাকে লিখব?
চুম্বনের দেশে আমি খরা বিশ্বাস করতে চাইনি কক্ষনও!
ঋণ
চোখে জল এসে যায়, আর
এত নরম তোমার সকালের রোদে
ভিজতে ভিজতে মনে পড়ে আমার
জন্ম থেকে বিচ্ছেদ শিখেছি...
ওই তোমার চুম্বন উড়ে গেল মেঘে
ওই যে তোমার
আদর শিশুকে চিনিয়ে দিল পাখি
আজকের পৃথিবীতে
কত তুচ্ছ প্রাণী আমি
এক কবি, কিছুই করি না
খালি এইসব নিয়ে থাকি
ভাবি, আর একটু দেখে যাই, আর একটু,
পৃথিবী ফু্রোচ্ছে প্রতিদিনই...
রাক্ষুসে প্রেমের জন্যে আমি
চোখের জলের কাছে ঋণী!
রহস্য
কোনও কোনও রাতে তুমি
আচমকা এক চিৎকার আর কম্পিত মোমবাতি
কোনও কোনও রাতে তুমি
একটি শরীর দিয়েছ অনেক আজানা পতঙ্গকে
কোনও কোনও রাতে তুমি
অন্ধ উটের আত্মজীবনী মরুভূমি-অনুবাদ
কোনও কোনও রাতে তুমি
কাব্য হয়েছ,
ঘরের বাইরে তুষারলিখিত চাঁদ
কোনও কোনও রাতে তুমি
মরতে চেয়েছ গানে বেদনায় পাঠকের সামনেই
"কোনও দিন কোনও রাতে
আমরা মরিনি, মরতে পারি না"
কবিতা-নিয়তি এই!
ঘোড়া
যদি বৃষ্টির রাতে
বাড়ি ফেরবার রাস্তাকে মনে হয়
কান্নায় ভিজে আছে...
দোলনচাঁপর গন্ধের ভূমিকাকে
তুচ্ছ করতে পারছেনা কিছুতেই,
মৃত্যুর মতো লাগছে...
দরজা-জানলা ভেঙে ফেলো, বন্ধু!
ধুয়ে-মুছে যাক ক্ষত।
একবার আন্তত
প্রেমিকাকে নিয়ে উড়ে যাও ছাদে...
আকাশ গর্ভবতী...
প্ররোচনা ঘিরে বাকি রাত শুধু ওড়া!
প্রতি চুম্বনে বেরিয়ে আসুক
অগ্নিমুখর ঘোড়া...
জন্ম-মৃত্যু
শেষ রাত... চুলে চাঁদ লেগে আছে...
আজ
মৃত্যুর
দায়।
গাছে গাছে কারা পরী রেখে গেছে,
চুম্বন
সামলায়...
(আবছা মেয়েরা ভালোবাসা দিত...
মনে পড়ে মুখ...
আমি শিহরিত!)
ভেজা চোখে দেখি,
একলা মানুষ
একা
ঘরে
ফিরে যায়...
দেবী
লম্ফ, মা-র হাতে লম্ফ জ্বলছে...
আমাদের প্রদীপ-ধরানো নেই,
সন্ধে-দেওয়া নেই, মা-র হাতে
লম্ফ জ্বলছে...
অপলক তাকিয়ে আমার কবি-ভবিষ্যৎ ভাবে,
এই
সন্ধে মহিষাসুর,
ওই মুখটা দেবীমুখ...
ভাইকে বলি-- ভাই, দ্যাখ, মা দুগ্গা ঠাকুর!
দুষ্টু ভাই মন্ত্র পড়ে ফিসফিস্...ফিসফিস্...
বাবা তখন ফেরেনি, দূরে মাটি কাটতে গেছে,
মা দাঁড়িয়ে লম্ফ হাতে... যিনি
দু্র্গতিনাশিনী
শিউলিতলা, হিমের পরশ,
লম্ফ,
দেবী--সমস্ত পেরিয়ে
বাবা ফেরে...একটু পরে
মহালয়া, ভোরবেলা বীরেন ভদ্রের
ফিরে ফিরে আসে শরতের
দিন, মহালয়া, বীরেন ভদ্রের...
লম্ফ হাতে দেবীও দাঁড়িয়ে...
মা, বাবা তো ঘরেই রয়েছে, তবু কার অপেক্ষায়?
দুষ্টুভাই দূরে থাকে,
তবু কানে ভেসে আসে তার গুনগুন্...
তুই কী রে দাদা! জানিস না মা খুঁজছে
বাংলাদেশ... যশোর টাউন...
ঝড়ের পাখি
জানলা ভেঙে
অতর্কিত আসে।
দুঃখিত মুখ, ঝড়ের বালি চুলে...
আমার আপস
ঘুমোচ্ছিল
শিরার ভেতর অন্ধ গোলাপফুল।
অতর্কিত দৌড়ে এল--
'জিভ কি তোমার কাটা?'
ঘরে আপস
ভয় পেয়েছে,
বাইরে কবিতাটা!
জানলা ভেঙে
অতর্কিত
আসে।
কপাল জুড়ে দগদগে সব ক্ষত!
সশস্ত্র চাঁদ
ধানের খেতে
চাইছে বুঝি আমারও সম্মতি?
কেউ আমাকে পছন্দ করুক, না করুক
কেউ
আমাকে পছন্দ করুক আর না করুক, আমি বলব, ছায়াকে ঘুমোতে দেওয়া জরুরি আর পেনসিল ঢুকিয়ে রাখা ভাল বাক্সে, কেউ
আমাকে পছন্দ করুক আর না করুক, আমি বলব, পেয়ারাফুলের গন্ধে শুয়ে থাকে এক বালিকা আর
প্রতিটি চায়ের দোকানদার আসলে দেবদূত, কেউ আমাকে পছন্দ করুক আর না করুক, আমি বলব
,নিঃশব্দ হও, ব্লেডের মত নিঃশব্দ... আর দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে দাও শিংঅলা অন্ধকার,
কেউ আমাকে পছন্দ করুক আর না করুক, আমি বলব, এমনভাবে হাত মেলে দাও শূন্যে, যাতে
তাকে সেতুর মতো দেখায়, আর ভরা জ্যোৎস্নায় সেতু বেয়ে লক্ষ লক্ষ মৌমাছি যেন আমাদের
পাড়ায় এসে পড়ে, কেউ পছন্দ করুক আর না করুক, আমি বলব, সেই লেখাই লেখো, যা তোমাকে
রক্ষা করতে পারবে না কখনও আর তুমি হয়ে ওঠো এমনই এক ভাষা, যা সর্বনাশের ভেতরই
সবচেয়ে ঝকঝকে দেখায়, কেউ পছন্দ করুক আর না করুক, আমার বয়ে গেছে, আমি জোর দিয়ে
বলছি, দিগন্ত আসলে রাক্ষস, প্রতিটি সূর্যাস্তে সে প্রজাপতি ধরে খায়...
পুরনো ঘর
পুরনো
ঘর, প্রতি রাতে মৃত্যু এসে ঘুমন্ত মুখে চুমু খেয়ে যেত, একদিন তার আঙুল কামড়ে ঘর
ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম... পুরনো ঘর, কাঁদতাম খুব, প্রথম-প্রথম বিশ্বাসই হত না
আমাদের আর দেখা হওয়া অসম্ভব... কিন্তু মৃত্যুভয়? সূর্যাস্ত হলেই গা শিউড়ে উঠত।
তবুও
কি আমি খুব ভাল ছিলাম, পুরনো ঘর? আমাকে পোকাদের সঙ্গে শুতে হত... লাউডগা সাপের
সঙ্গে... কিংবা মৌমাছি, যারা আমার চোখ থেকে মধু শুষে নিত প্রাণপণ... সারারাত তাদের
মহল্লায় আমার অর্জিত জন্মগুলো চুরি হয়ে যেত। আজ খুব মজা, প্রচন্ড ঝড়ে সবারই ঘুম
উড়ে গেছে, আমিও উড়ে গেছি সামান্য খড়কুটো, তারপর কখন যেন এক অন্ধকারে লটকে গিয়ে
তোমাকে চিনেছি, তোমার হিংসুটে ঝুলকালি থামাও, পুরনো ঘর... এতদিন বাদে আমাকে দেখতে
দাও কারা রোজ রোজ আমাকে এত এত চিঠি লিখত, আমার ফেলে যাওয়া বইগুলো আমি তাদের হিংস্র
হয়ে ওঠার অনুমতি দিলাম, আমার কবেকার লেখার কাগজ, হলুদ হতে তোমাদের ঘেন্না লাগে না?
না লেখা আগুন-অক্ষরে জ্বলে ওঠো আজ।
আজ
খুব মজা, ঝড় থেমে যাবার আগেই পুরনো ঘর স্বপ্নে পুড়ে ছাই... কোনও পিছুটান নেই, তবু
পুরনো ঘর, তোমাকে
ব্যক্তিগত হয়েও বহুমুখীন
আলোচনা করলেন সঙ্ঘমিত্রা হালদার
সংবেদনশীল মানুষ টের পায় তার মধ্যে কখনও বা একটা জলাভূমির
আবহাওয়া ঘনিয়ে উঠছে। কখনও বা বৃষ্টিভেজা সোঁদা মাটির গন্ধ তো পরক্ষণেই একরোখা দহন।
পাশাপাশি এক দানব সভ্যতার অভিপ্রায় ছায়া ফেলে তার সকল মেঠোপথে, রাজপথে। মনোপথে। তার সঙ্গে মোলাকাত হয়, একেবারে
একা। দৃশ্যমান সমান্তরাল পথ আসলে ততটা সমান্তরাল নয় অন্তর্ঘাতে, ত্রাসে। একে অন্যের ভিতরে কেবলই সেঁধিয়ে যেতে চায়। উঠতে বসতে পায়ের কাঁটা
পায়েই আত্মগোপন করে থাকে। হয়ত বা রক্তাক্ত করে। মানুষ পথ খোঁজে। ভুলে থাকতে চায়।
একজন কবিতালেখক তার পথ খোঁজে। কবিতায়। পায় বা পায় না।
একজন কবিতালেখকের মাত্র কিছু কবিতা পড়ে এই যে ভূমিকাটা হতে পারল, তা নির্ঘাত তাঁর কবিতা-মন টইটম্বুর বলেই। কবিতাটা যদি সরোবর
হয় তো সেখানে মাইল ব্যাপী ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মন। আর সবকিছু ছাপিয়ে। মনের নানা
শিরা-উপশিরা। তার নানা অভিব্যক্তি, অনুভূতি। আর অনুভূতি
থাকলে তার হর্ষ-বিষাদ-আনন্দ- দুঃখ সবটাই থাকে। থাকে আরও এমন কিছু যাকে ঠিক চেনা
যায় না, কিন্তু পীড়া দেয়। ছায়া ফেলে। অবশ্য এই কবিতাগুলোর
কবিতা লেখক হয়ত তুলনায় নিরাপদ, কেননা এহেন অনুভূতির তেমন
ছায়া বা প্রচ্ছায়া তাঁর কবিতাকে গত্যন্তরে নিয়ে যায় না। তাঁর কবিতা
বেশ কিছুটা শেষের মেজাজ এনে তবেই শেষ হয়। আচানক নেই।
সভ্যতার দানবীয় শরীর যখন মানুষকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে, মানুষের খুব কিছু করার থাকে না। সভ্যতা কেবল তার পরিণতির দিকে
এগোয়। মানুষ তখন পুতুলবৎ। ঘৃতাহুতিটুকু না দিয়ে উপায় থাকে না। একসময় মুক্তির
ইচ্ছেটুকু চলে যায়। কিন্তু একজন কবিতালেখক তো তাঁর ইচ্ছের যথার্থ দোসর। কখনও তিনি
সঙ্গত করেন ইচ্ছেকে তো কখনও ‘ইচ্ছে’ সঙ্গত
করে তাঁকে—
ভয় করছে আমার, খুব ভয় করছে, আর লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয় গাছের শিকড়ে, যখন মানুষের ঘিলু থেকে বেরোচ্ছে বারুদের ধোঁয়া, যখন লাল হয়ে যাচ্ছে সবুজ শান্ত মফসসল, বিকট চিৎকার করছে শুকিয়ে যাওয়া নদীর মতো আমাদের মা, আমার অবাক লাগে একজন সাংবাদিকও মরছে না, একজন নেতাও না, পণ্ডিতেরা
টিকি নেড়ে ভাগ হয়ে যাচ্ছে দু' পক্ষে, অথচ মরছে কেবলই মরছে অগুনতি ধানগাছ, গাংশালিখ, বোবা হয়ে
যাচ্ছে বুলবুলি, কে জানে গণতন্ত্র কীরকম? সে কি এক ফোকলা স্বৈরাচারী? সে কি এক উচ্চাকাঙক্ষী পাগল মনসা? আজ ট্রেন বাস থেমে গেল কলকাতায়, খুব ভয় করছে, ভয় করছে আমার, আঃ নেটওয়ার্ক ব্যস্ত
থাকায় মেয়েকে ধরতে পারছিনা ফোনে, আটটা পাঁচ বাতিল... ন'টা দুই বাতিল... ন'টা তিরিশ বাতিল... শিয়ালদহ বন্দরে ঘরে ফিরতে চাওয়া মানুষের ভিড় ক্রমশই বাড়ছে, হু হু হাওয়া এল, উড়ে যাচ্ছি দু'-একটা মানুষ
শূন্যে, আপাতত বনগাঁয়
কোনও গণ্ডগোল নেই, কিন্তু ওখানেও
তো লাখো লাখো ধানগাছ, তার অরক্ষিত
আলে কোনও রোববার আমি আর মেয়ে গিয়ে দাঁড়াব কথা আছে, কোথাও রক্ত নেই, তবু সাদা
ফ্রকের প্রান্ত বুলিয়ে আমার ছোট্ট মেয়ে ধানগাছের পাতা মুছিয়ে দেবে কত যত্ন ক'রে, আমার হাসি
পাবে,
কান্না পাবে, আমিও হাঁটু গেড়ে বসব মাটির ওপর, আলের ঘাস থেকে তুলে নেব শিশির, চোখের পাতায় বুলোব, কে কার অশ্রু
আর চেনাই যাবে না, আর আজ নিয়তিতাড়িত কোনও
ট্রেনে গাদাগাদি হয়ে বাড়ি ফেরার পথে দেখতে পাব কালো পুলিশের গাড়িটাকে তাড়া করেছে
এক লাল দমকল, পাগলের মতো ঘন্টা বাজছে
চরাচরে,
ওরা কোন জাহান্নামে যাবে জানি না, তার আগেই আমাকে পৌঁছে যেতে হবে মৃত নদীর গর্ভে...
বাকি রাতটুকু আমি বালি খুঁড়ব, বালি খুঁড়ব, মেয়ে ঝুঁকে পড়ে বলবে, জল...
(পাগলের মতো ঘন্টা
বাজছে চরাচরে)
কবিতাটা পড়তে পড়তে আমার কেবলই চোখ চলে যায় ‘গাছের শিকড়ে’। কিন্তু ‘গাছের শিকড়’
কেন? মানুষ তার ধারাবাহিক ইতিহাসে কেবলই সতত
তার শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন বলে সে কি নিজের অসহায়তার বিপ্রতীপে সবসময় শক্ত নিরাপদ
একটা অবস্থা খোঁজে? গাছের শিকড়—যা কিনা
মাটির বুকে মুখ ডুবিয়ে রাখে, যে আছে, অথচ
মাটির উপরে সেভাবে নেই। যে সকল ত্রাস আর স্বেচ্ছাচার থেকে নিজেকে গোপন করার কৌশল
জানে। তার মতো নিরাপদ একটা আকাঙ্ক্ষা পুষে রাখে, মানুষ তার
নিজের গভীরে? আর তাই সব ইমেজ ফেলে শব্দ-চয়ন কেবল এই
নির্দিষ্ট ইমেজকে নির্বাচন করে নিচ্ছে। কেননা শব্দ-চয়ন আমাদের আমাদের মনোজগতের
ফসল। সে কাকে বাদ দেবে, কাকে নির্বাচন করবে তা নির্ভর করে
তার নানা অভিজ্ঞতা-স্মৃতি-বিস্মৃতি-সংবেদন ক্ষমতার উপর। উপরে যে কবিতাটা আমরা
এক্ষুণি পড়লাম, তার শব্দচয়ন কবিতালেখকের ব্যক্তি-অনুভূতির
পরতগুলো চেনানোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সঙ্গেও প্রবলভাবে কথা বলছে। সবচেয়ে বড় কথা,
বর্ণনামূলক কবিতা হয়েও সে এতটুকু তার বর্ণনার চৌহদ্দিতে আটকে নেই।
কথায় কোথাও ভাঁটা নেই। তোড় আছে। তোড়ে খানিকটা ভেসে যাওয়াও আছে। চমৎকৃত হই ‘ফোকলা স্বৈরাচারী’, ‘উচ্চাকাঙক্ষী পাগল মনসা’র মতো শব্দবন্ধের সমাহারে।
ব্যবহারে। সত্যিই তো স্বৈরাচারী কেবল শিশু কিংবা অতিবৃদ্ধই হতে পারে। যার জীবনের
মধ্যবর্তী পর্যায়গুলোয় কখনও নোঙর ফেলা হয় না। আর মনসা তো উচ্চাকাঙ্ক্ষীই। তবে তার
জীবনসংগ্রামও আছে সেখানে। এমন সূক্ষ্ম উইট বেশ বিরল। বিরল, যা
ভিড়ে থাকে না। কিন্তু শোভাবর্ধন করে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন