
কবির নাম, বয়স, লিঙ্গ, ঠিকানা ইত্যাদি যা কিছু কবিতার জন্য জরুরি নয়, তা আমরা মুছে দিয়েছি। আর এভাবেই ১০টি কবিতা পাঠানো হয়েছে অন্য এক কবির কাছে- আলোচনার জন্য। শুধু ১০টি কবিতা, আগে পরে নাথিং। আমাদের সাথে রুমালচুরির এই খেলা খেললেন ১৯ জন কবি।
এখানেও কবির নাম ছাড়া ১০টি কবিতা রাখা হল, সঙ্গে থাকলো আলোচনা। কবির নাম জানার রাস্তা কবিতার নীচ দিয়ে গেছে। তবে আমরা বলবো রুমালচুরির এই খেলায় আপনিও থাকুন। কবির নামটা না হয় একটু পরেই জানলেন।
১০টি কবিতা
বিবর্তনের পুতুল
হ্যাঁ পেট থেকে পিঠে - দরদাম থেকে নিলামিতে - ঘোরে
ঘোরে নেমেছি আসনে - আসন আমার মা - মা–ই আমার আসন - আসন থেকে পিঁপড়ে হয়ে - পাখার
দিকে তাকাই - আমার কত সংখ্যা - আমার কত বাস্তু - চিবিয়ে চিবিয়ে ধর্ম নিয়ে গুচ্ছমূলে
আসি - রস নিয়ে প্রাণের ভেতর শোষণ শোষণ খেলাই - এখানে রান্নাঘরে লাইটারেরা বাতাস
বুঝে চলে - আমি তার জ্বলন দেখি, ফুলকি ভেবে হাসি - ফুলকি, ফুলকি,ফুলকি - কী হালকা
এক বিধ্বংসী ভবিষ্যতের গল্প - আগুন কত নীল আলোয় জ্বলে - চিলের মতো আড়ালমাফিক গতি -
শকুন অভিযান - শকুন অভিমান - শকুনশক্তি ভাগাড়ে গিয়ে পড়ে - ভাগাড় থেকে ওপরে তাকায়
ইঁদুর - জীবনচোর, জীবনচোর -আমায় খাবি তুই - খা, খা কত খাবি খা - খাওয়ারও এক
গোনা-গুণতি পেট - সীমা ছাড়িয়ে উঠতে পারে না - সিদ্ধ জীবন দপদপিয়ে আগুন টানে রোজ - এই
আসন আসন খেলা - আসল আসল খেলা - দাবার মতো বুদ্ধি করে বসে - চোরেরা সব উল্টোদিকে
আঙুল দেখায় রোজ - রোজ তারা নির্বাসনের পাখি - দেশান্তরের ঘোর - তবু কত বাঁচবে বলে
- গলার নলি দপদপিয়ে নাচে - যাকে যত গ্রাস খাওয়াবে - সে তত আঙুল কামড়ে নেবে - আঙুল
এক দুর্বলতার মেশিন - চোখ ও আঙুল কাউকে দিতে নেই - চোখ ও আঙুল লুকিয়ে লুকিয়ে রেখো -আমরা
বিবর্তনের পুতুল - হিংসে নিয়ে বাঁচি
বাহুল্য
শ্লীল থেকে ধার্য হয়ে যা নেমে যায়
যার থেকে কম হলে
আমি ও আপনি ক্ষুধার্ত ও হ্যাংলা হয়ে
অন্যকে দেখি লোলুপ ভাবে,
আসুন সেদিকে এসে বসি
খেয়ে নিই দু’গ্রাস
পাপ পর্যাপ্ত না হলে ভয় আসে না
পাপ পর্যাপ্ত না হলে পাপী পুণ্যের জন্য কাঁদে না-
পিং-পং
উল্টে গিয়ে বসে আছি
দেখছি কী তীব্র খেঁকশেয়াল!
শুনছি কী তীব্র তার শব্দ!
আমার ঘরের মেঝেতে তার আতুড়
আমার কোলে তার শিশু
ক্রমশ খেচর হয়ে গেলাম
সমস্ত নিম্নজ অঙ্গে দেখলাম মুদ্রা
স্তনের বদলে গলা থেকে বেরোলো দুধের ধারা
মাথায় এসে ডমরু বাজাচ্ছে বোলতা
আমার সারা শরীর জুড়ে একটা মা,
আমার সারা শরীর জুড়ে একটা বাবা,
আমি কী ইন্দ্রের গায়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!
অগ্নি এসে দেখলেন চুমু খেতে খেতে
বাষ্প হয়ে যাচ্ছি আমি
আর কী সব শব্দ চাষ করে
নিয়ত জন্মাচ্ছি চাষীর ঘরে!
নারীত্বের মাথায় এসে বসেছে মণি
মণির লোভে সমস্ত সাধকের
একপক্ষকাল
পক্ষাঘাত-
এত কী বুঝতে চাইছ
সমস্ত বোঝার উর্দ্ধে এই বেঁচে থাকা...
কিছু পরে
আসলে বলছিলাম কিছু পরে,
কিছু পরে ফিরে আসব
সময় একটা অলীক অতীত হতে পারে
-তোমার কাছে
আমার কাছে বিশ্রামরত শিল মাছের বোকা হেলান
তুমি নির্বাক অথচ ঘনিষ্ঠ বলে যন্ত্রণায় আঠা লাগাই
মিথ্যে কিছু সময় বন্ধ রাখি
তুমি অপেক্ষারত- ভাবলেই ভুল করি
এই সময়টা বাহানার বাসনায় ফেরত দেব তোমায়
আসলে তোমারও কিছু পরে যাব আমি
চলে যাওয়াটা একটা অশরীরী রীতি
যদি জানো ব্যাথা কোথায়, তাহলে তুমি ব্যাথিত নও
যদি জানো ব্যাথা কোথাও নেই, অথচ তুমি ব্যাথিত
তাহলে জেনো, পর্ণমোচীর শেষ পাতার মতো
জর্জরিত হয়ে গেছে তোমার গন্ধ
এটা প্রয়োজন, আরো কিছু পরে তুমি বুঝবে
আমারও যাওয়াটা তোমার নিতান্ত প্রয়োজন
নখ
চাঁদের আলোয় নেমে আসি চুল থেকে
ঘন আরো ঘন হয়ে
মায়ের পাশে এসে দেখি, নাভিরজ্জু...
পিপাসায় পিপাসায় ক্রমশ মানবিক হই
ঘরের ভেতরে বসে আছে জাদুকর
ঘরের ভেতরে বসে আছে ভাগ্যবান
ভেজা ছাদ থেকে খসে পড়ছে রাগিনী
এইখানে আমি ও মা, মা ও আমি
নখের জন্য রঙিন হয়ে গেছি...
মটরদানা
এ ক্ষুদ্র সংসার
নিঃসঙ্গ মটরদানা
পাশে শুয়ে নরম
জলোচ্ছ্বাস
একঘর সুখ দাও দেবতা
টেবিলের গা বেয়ে ওরা চলে যাচ্ছে
এ ক্ষুদ্র সংসার
অধরা মটরদানা
ছেঁড়া ব্লাউজের একটা মেয়ে
পেট খামচাচ্ছে-
দীর্ঘ পাপের সঙ্গে
একান্ত পাপের পর যদি নিবিড় ঘুম আসে
ভেবে নিতে পারো পাপ বলে কিছু নেই
আসলে গুমখুনের পর কিছু চিহ্ন লুকিয়েছিলে
বিশিষ্ট সম্মানে গাছের পায়ে ফুটেছে
পোড়োবাড়ির পিপাসা-
তাতে লেগে আছে ঘনিষ্ঠ মিলন চিহ্ন
যা হয়নি অথবা হতে গেলে
তোমাকে একপ্রস্থ আলোচোর হতে হয়
-তাই হও
দেয়ালের গায়ে পেশি রেখে দেখো
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তোমাকে বার্তা দিচ্ছে
-কি নিদারুণ অসহায় তুমি
যেন পোড়োবাড়ির বিদগ্ধ দারোয়ান
তোমারি যত্নের বাইরে ফুটেছে অবৈধ ফুল
তুমি নিষ্কাশনকামী অথচ দুর্বল
দীর্ঘ পাপের পর তুমি বাণপ্রস্থে যেয়ো
ঘরে রেখে যেয়ো বনচায়নার পেয়ালা
নরকঙ্কালের সামনে রেখো ত্যাগ
আসলে ভোগের ভেতরে লুকিয়ে আছে পার্থিব সন্ন্যাস
দীর্ঘ প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি তুমি মানুষ
আর মানুষ হয়ে প্রসব করেছ পশু
তোমার একনেত্র তরঙ্গ ধরে
হয়ে গেছি এক মূর্খ প্রতিফলন-
চড়
এক বসন্তের দুপুরে ঈশ্বরে তীব্র চড় কষালেন
সেলটিক সুর আর পর্যাপ্ত নিলামির আওতায়
মরুভূমির ঝড় থেকে নামলাম চোখের তটে
সে এক খাড়া পথ,
উন্মাদ ট্রেন
মৃত্যুর অনশন নিয়ে এসেছিলেন ঈশ্বর
চড় মেরেছেন বলে নিজেই নিভৃতে আদর করেন এখন
অস্বচ্ছ সেলুলয়েড থেকে নামি থ্রি জি আলোয়
নান্দনিক গুহায় অজস্র ভাষা নিয়ে ঘুরছে পিঁপড়ে
পুরাতন গ্রিক মিথে জন্মের চারদিন পরে
দেবতার মতো নিজের চাটাই খুঁজতে বেরোয়
দেশীয় ঈশ্বর এসে নাভি আরক্ত করেন
পাতালে এসে ভুল প্রেম করি
সে আমার গলার তন্ত্রী কামড়ে নেয়
বিভক্ত হতে পারিনি বলে
কোমল স্বরে এসে সে খসে
দূষিত অলঙ্কার হয়ে
যুগের জাঙ্ক নাম দিয়েছি তাকে
ফাঁটা আয়নায় লুকিয়েছি পুরুষের নিষ্ক্রিয় বুক
চোরাস্বপ্নে মোড়া নখের আঁচড়ে, কান্নায়
ঘুমন্ত পিতৃ অবয়বে অজানা মেরুদণ্ড খুলি
কোথাও একটা দোলনা যদি পাই...
বীতংস
আকাশ থেকে নেমে আসছে কপিকল
এক পাশের দড়িতে পশু আর পাখি- বীতংস
অপর দিকে মানুষ
এবার বিষণ্ন গ্যালাক্সি থেকে
বিষ্ঠা ছুঁড়বে রাহু, কেতু, শনি, মঙ্গল
দ্রাঘিমায় বসে স্পোক সারাচ্ছে চাষী
এটা যুগভিত্তিক টেস্টটিউবের টিসু কালচার
ও মা! সেটা কত সাল হবে
যখন হিসি ব্যাঙ্কে জমা রাখার জন্য বোঝাবে দালাল
দালালকে দেখাতে হবে দলিল
দলিলের পিছনে থাকবে নীল ছবির বিজ্ঞাপন
এবার আকাশ থেকে নামবেন কৃষ্ণ ও শাম্ব
নান্দনিক সুইমিং পুলে হিসাবযোগ্য হবে তলপেট
ভাবার আগেই কৃষ্ণের পায়ে নেমে যাবে নিয়তি
এসো, ঠিক যেমন করে দেয়ালে ঠেলে
আবদ্ধ চুম্বন করেছিলে
সেখানেই ইকির-মিকির খেলি আরো একযুগ
আর আমাকে মা-কালীর পায়ে হাত দিয়ে
কেউ প্রতিজ্ঞা করাক কতটা শ্লীল আমি!
আমার কত নম্বর তিলে
তোমার পিলে চমকে গ্যাছে - জানতে চাই না
ভাঙা ইঞ্জিনের গায়ে রাখব নানচাকু
আর বুকের মাঝখান খুলে দিয়ে বলব দ্যাখো
ওকে উপনিবেশের ভূগোল ভাবলে
শূলের উপনিষদে তুমি একটা অঙ্কুরিত পচা ছোলা
তিলে, পিলে, খালে
এক পা ফাঁক করে হিসি করছে শিশুটা
ওকে কুকুর হতে শিখিও না
শিখিও না হি আর সি
তরঙ্গ – যৌনতা –ভালবাসা
এক-কেন্দ্রিক বৃত্তের জ্যা চেনার মতো
চুমু খাও - একটাই চুমু খাও
চুমু খেয়ে
খেয়ে নাও গোটা একটা আত্মা !
চারকোল
পুতুল খেলার মতো এখানে এসেছি
পড়ে গেছি পা পিছলে!
ওরা যারা পিছিয়েছিল তাদের এগোনোর গল্প আমি জানি,
আমার ভালো লাগে জয় দেখলে
জয় একটা সামগ্রিক ছকের অভিযান!
আর তার সমস্ত অংশ জুড়ে চক্র
যেখানে এগোনোরা পিছোবে
আর পিছনোরা এগোবে-
সামগ্রিক জয় আমায় সামগ্রিক পরাজয়ের কথা ভাবায়
আর সামগ্রিক পরাজয়...
এভাবেই চক্রের খেলা দেখতে দেখতে শিখি
অভয়ারণ্যের গায়ের বনাঞ্চল জুড়ে
নিরামিষ আর আমিষের গ্রহণ দেখি
চক্রের কথা বুঝে গেলে আপনি চারকোল কে হীরে
আর হীরে কে চারকোল ভাবতে পারবেন
আর ভেতরের গল্প জানার জন্য
আমাদের চক্রকালীন সুদ-এর আশ্রয় নিতে হবে
চক্র বুঝে গেলে পৃথিবীর সব ভালবাসা যায়-সব
আলোচনা করলেন স্বপন রায়
শক্তি কী?একটি বিন্দুতেই
কেন্দ্রীভূত নাকি ওমনিপ্রেজেন্ট অর্থাৎ সবখানেই? যার আগমন, নির্গমন নেই। এক তন্ত্রে বাধা
বিমূর্ততা, তাকে না দেখা যায়, না ধরা
যায়। এরপরে পড়ে থাকলো চেতনা আর তার
ট্রিগারটি, অনুভূতি। এইস্তরে যে ইমেজারি আসানো-বেরোনো তূনীর
হতে থাকে তার একেকটা সরণ, প্রতিসরণ এমনকি ফলন, প্রতিফলন নিয়ে কবিতা জায়মান হয়। আমি যে কবির কবিতা নিয়ে লিখছি তিনি শক্তির
বিস্তারে রাখা এক কেন্দ্রাভিমুখি চেতনাপ্রবাহকে ভাষা দিয়েছেন। একদিকে বিস্তার
অন্যদিকে সঙ্কোচন, এও দুনিয়াদারি। যা অন্যভাবে একসময় ‘আপোলিনের অ্যান্ড কো’ খুব খেলেছিলেন। আলোচ্য কবি
কিন্তু কেবল বস্তুর অন্তর্গলনাঙ্কে নিজের লেখা খোঁজেন নি। তাঁর কাছে প্রকৃতিই
চৈতন্যময়ী, তিনি মা!
‘হ্যাঁ পেট থেকে পিঠে- দরদাম থেকে
নিলামিতে- ঘোরে ঘোরে নেমেছি আসনে- আসন আমার মা- মা –ই আমার আসন- আসন থেকে পিঁপড়ে
হয়ে- পাখার দিকে তাকাই- আমার কত সংখ্যা- আমার কত বাস্তু- চিবিয়ে চিবিয়ে ধর্ম নিয়ে
গুচ্ছমূলে আসি- রস নিয়ে প্রাণের ভেতর শোষণ শোষণ খেলাই- এখানে রান্নাঘরে লাইটারেরা
বাতাস বুঝে চলে- আমি তার জ্বলন দেখি, ফুলকি ভেবে হাসি’
যেন ক্যালাইডোস্কোপ! চেতনা চলে যাচ্ছে
মূর্ত থেকে বিমূর্তে! কবিতা কিন্তু এক রসায়ন যার বিক্রিয়ায় ভাবনা ঘটকের ভূমিকা
নেয়। আলোচ্য কবির ভাবনারা অন্তর্মুখি, অপসরণের কাফেলায় তিনি আসীন কিন্তু তাঁর
বিচরণে কোন নির্মাণ বা বিনির্মাণ নেই, কবি অন্ধকারের
নিভৃতিতে আলোর ঈশারা এনে তাকে দৃশ্য করে দেননি। কবি এই দেখাশোনাগুলো কালচক্রের
অভিজ্ঞতায় রেখেছেন। কালচক্র আপাতদৃষ্টিতে সময়শাসিত হলেও শরীরের ভেতরে চৈতন্যের
উন্মেষে তার গতি ষটচক্রের আবহে কুণ্ডলী পাকিয়ে যায়। যোগ মতে ‘কুণ্ডলিনী’ শক্তিকে জাগ্রত করতে যোগীকে ‘ষট্চক্র’ ভেদ করতে হয়। যোগবাতন্ত্রশাস্ত্র বিশ্বাস করে, প্রতিটি মানব দেহে ছটি চক্র আছে। চক্র ছটির অবস্থান গুহ্যে, লিঙ্গমূলে, নাভিতে, হৃদয়ে, কণ্ঠে ও ভ্রুদ্বয়ের মাঝখানে। ছ’টি চক্রের নাম গুহ্যে মূলাধার
চক্র থেকে পর্যায়ক্রমে স্বাধিষ্ঠান,
মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও জ্ঞান চক্র। মস্তিষ্কে আছে সহস্রদল পদ্ম। যোগের বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে মূলাধার
চক্রকে একের পর এক ছটি চক্র ভেদ করে কুণ্ডলিনী শক্তিকে মস্তিষ্কে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মাথার খুলির নীচে রয়েছে সহস্রদল
পদ্ম কুঁড়ি। কুঁড়ির ওপর
ফণা মেলে থাকে সাপ। যার লেজ রয়েছে
গুহ্যে। যোগ প্রক্রিয়ার সাহায্যে, বা বলতে পারি তন্ত্র প্রক্রিয়ার সাহায্যে ফণাটি সরিয়ে দিতে সক্ষম
হলেই মস্তিষ্কে হাজারটা রঙিন পাপড়ি মেলে ফুটে উঠবে পদ্ম। এই যে সাপ বা মহাশঙ্খিনী শক্তি, ইনিই মহামায়া,
মহা শক্তি। পদ্মের কর্ণিকা বা বীজকোষে রয়েছেন ব্রহ্ম
স্বরূপ শিব। তো এই যে
চেতনার শক্তি বা এনার্জি বাংলায় খুব কম কবির লেখায় পরিসর পেয়েছে। আলোচ্য কবি এটা
করেছেন দেখে ভাল তো লাগছেই, তাঁকে সাবাশিও জানাচ্ছি। আমার নিজের লেখালিখিতে যেহেতু
অধিবাস্তব এবং পরাবাস্তব থাকেই না তাই যখন কারো লেখায় এই অনাস্বাদিত অনুভূতির
প্রকাশ দেখি, আটকে যাই।
‘আর পিছনোরা এগোবে-
সামগ্রিক জয় আমায়
সামগ্রিক পরাজয়ের কথা ভাবায়
আর সামগ্রিক পরাজয়...
এভাবেই চক্রের খেলা
দেখতে দেখতে শিখি
অভয়ারণ্যের গায়ের
বনাঞ্চল জুড়ে
নিরামিষ আর আমিষের
গ্রহণ দেখি
চক্রের কথা বুঝে গেলে
আপনি চারকোল কে হীরে
আর হীরে কে চারকোল
ভাবতে পারবেন
আর ভেতরের গল্প জানার
জন্য
আমাদের চক্রকালীন
সুদ-এর আশ্রয় নিতে হবে
চক্র বুঝে গেলে
পৃথিবীর সব ভালবাসা যায়- সব’
কবিতায় দর্শনের বাহুল্যে কবিতার কি হয়
জানিনা, কবির
দার্শনিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই কবি সেই সম্ভবনায় আছেন। দুটো দিকের রহস্যই
তাঁর সান্নিধ্যে রয়েছে, তাদের গরম আর ঠাণ্ডা, তাদের আশা , নিরাশা, তাদের চলন
ও অপসরণ এই কবিকে অধিবাস্তবতায় নিয়ে গেছে। পরাবাস্তবের শিকড় যেমন ফ্রান্সে,
অধিবাস্তবতার জনক কিন্তু ভারতবর্ষ! তাকে আধ্যাত্মিক রঙ দেয়া হলেও
সামবেদ থেকে গীতায় অধিবাস্তবতাই মানসিক মুক্তির রাস্তা দেখিয়েছে। আলোচ্য কবি এই
প্রায় অনাস্বাদিত ভাবনার কবিতা লিখেছেন অনায়াস দক্ষতায়। এবারে একটি পুরো কবিতা
তুলে দিচ্ছি কবি যেখানে এই ষটচক্রের সহস্রারমুখি আভ্যন্তরীণ স্রোতের নিরিখে
বর্হিপৃথিবীর সামাজিক পতনকে লিপিত করেছেনঃ
‘আকাশ থেকে নেমে আসছে কপিকল
এক পাশের দড়িতে পশু আর
পাখি- বীতংস
অপর দিকে মানুষ
এবার বিষণ্ন
গ্যালাক্সি থেকে
বিষ্ঠা ছুঁড়বে রাহু, কেতু, শনি, মঙ্গল
দ্রাঘিমায় বসে স্পোক
সারাচ্ছে চাষী
এটা যুগভিত্তিক
টেস্টটিউবের টিসু কালচার
ও মা! সেটা কত সাল হবে
যখন হিসি ব্যাঙ্কে জমা
রাখার জন্য বোঝাবে দালাল
দালালকে দেখাতে হবে দলিল
দলিলের পিছনে থাকবে
নীল ছবির বিজ্ঞাপন
এবার আকাশ থেকে নামবেন
কৃষ্ণ ও শাম্ব
নান্দনিক সুইমিং পুলে
হিসাবযোগ্য হবে তলপেট
ভাবার আগেই কৃষ্ণের
পায়ে নেমে যাবে নিয়তি
এসো, ঠিক যেমন করে
দেয়ালে ঠেলে
আবদ্ধ চুম্বন করেছিলে
সেখানেই ইকির-মিকির
খেলি আরো একযুগ
আর আমাকে মা-কালীর
পায়ে হাত দিয়ে
কেউ প্রতিজ্ঞা করাক
কতটা শ্লীল আমি!
আমার কত নম্বর তিলে
তোমার পিলে চমকে
গ্যাছে- জানতে চাই না
ভাঙা ইঞ্জিনের গায়ে
রাখব নানচাকু
আর বুকের মাঝখান খুলে
দিয়ে বলব দ্যাখো
ওকে উপনিবেশের ভূগোল
ভাবলে
শূলের উপনিষদে তুমি
একটা অঙ্কুরিত পচা ছোলা
তিলে, পিলে, খালে
এক পা ফাঁক করে হিসি
করছে শিশুটা
ওকে কুকুর হতে শিখিও
না
শিখিও না হি আর সি
তরঙ্গ – যৌনতা –ভালবাসা
এক-কেন্দ্রিক বৃত্তের
জ্যা চেনার মতো
চুমু খাও- একটাই চুমু
খাও
চুমু খেয়ে
খেয়ে নাও গোটা একটা
আত্মা !’
আত্মাকে আত্মসাৎ করা মানে মানুষের
সবকিছু, তার চিন্তা
চেতনাকেও আত্মসাৎ করা। চেতনা সহস্রারের উল্টো পথে গেলে তাই হয়। আকাশ থেকে পড়ুক
অথবা সহস্রার থেকে এই নিম্নতার আবহকে কবি এভাবে লেখেনঃ
‘শূলের উপনিষদে তুমি একটা অঙ্কুরিত
পচা ছোলা
তিলে, পিলে, খালে
এক পা ফাঁক করে হিসি
করছে শিশুটা
ওকে কুকুর হতে শিখিও
না..’
এই কবিতাটি এক আত্মভেদী চেতনার
যাত্রা। কবিকে বাহবা দিতেই হয় এমন রচনার জন্য।
অধিজগতের সঙ্গে কবি যোগ আর বিয়োগের
খেলায় মেতেছেন, আমার অন্তত তাই মনে হল। সে ঈশ্বরই হোক বা আত্মা, এই
খেলায় কবিরা ভুমিকা শুধু দর্শকের নয়, খেলুড়েরও! এক অচেনা
এনার্জিকে তিনি চাইছেন, দেখছেনও হয়ত চেতনার আলোয় আর তার
প্রক্ষেপিত ভাবনাগুলোকে লিপিত করেছেন বাস্তবের আয়নায়। আয়না কথাটা ইচ্ছে করেই
লিখলাম। লাকাঁ যেমন বলেছেন ‘মিরর ইমেজ’ যা নিজের আলাদা ছবি, যেখানে ডান বাঁ হয়ে যায়,
বাঁ ডান! নইলে কবি লিখবেন কেনঃ
বিশিষ্ট সম্মানে গাছের
পায়ে ফুটেছে
পোড়োবাড়ির পিপাসা-
তাতে লেগে আছে ঘনিষ্ঠ
মিলন চিহ্ন
যা হয়নি অথবা হতে গেলে
তোমাকে একপ্রস্থ
আলোচোর হতে হয়
এই যে তোমাকে আলোচোর হতে হয় এ সেই
অন্যছবির খেলা যা আত্মশুদ্ধি জানেনা। যে নিজের অধীন নয়। তাকে পরিচালনা করে
আত্মছবিটি যেভাবে আমরা চেতনার বিবিধে পরিচালিত হই বিভিন্ন চক্রে, বিভিন্ন দশায়। কবির
এই দর্শন ব্যতিরেকে কবিতাগুলো আবছাই থেকে যাবে এবং কবিও মনে হয় তাই চান। তিনি এক
অপ্রকাশ্য চিন্তনবিধিকে কবিতা করেছেন। সেই গোপন বিদ্যার অতলান্তিক রহস্যকেই তিনি
রাখতে চান পাঠকের কাছে। কবিতাগুলোয় তাই অনাদায়ী জীবনের ফসল যেমন আছে তেমনি আছে
কবির দার্শনিক বীক্ষা। পড়া যাক কিছু কবিতার অংশঃ
১.‘-কি নিদারুণ অসহায় তুমি
যেন পোড়োবাড়ির বিদগ্ধ
দারোয়ান
তোমারি যত্নের বাইরে
ফুটেছে অবৈধ ফুল
তুমি নিষ্কাশনকামী অথচ
দুর্বল
দীর্ঘ পাপের পর তুমি
বাণপ্রস্থে যেয়ো
ঘরে রেখে যেয়ো
বনচায়নার পেয়ালা’
২. ‘ঘরের ভেতরে বসে আছে ভাগ্যবান
ভেজা ছাদ থেকে খসে
পড়ছে রাগিনী
এইখানে আমি ও মা, মা ও আমি
নখের জন্য রঙিন হয়ে
গেছি...’
৩. ‘মিথ্যে কিছু সময় বন্ধ রাখি
তুমি অপেক্ষারত-
ভাবলেই ভুল করি
এই সময়টা বাহানার
বাসনায় ফেরত দেব তোমায়
আসলে তোমারও কিছু পরে
যাব আমি
চলে যাওয়াটা একটা
অশরীরী রীতি
যদি জানো ব্যাথা কোথায়, তাহলে
তুমি ব্যাথিত নও
যদি জানো ব্যাথা কোথাও
নেই, অথচ
তুমি ব্যাথিত
তাহলে জেনো, পর্ণমোচীর শেষ
পাতার মতো
জর্জরিত হয়ে গেছে
তোমার গন্ধ..’
আলোচ্য কবিতাগুলিতে কবি এক নিঃসঙ্গ
বৈরাগ্যে কবিতাকে রাঙিয়েছেন। কবিতারও রঙ হয়। ভাবনার রঙ। অপ্রচলিত রাস্তায় হেঁটে
লিখেছেন এইসব বিরল ভাবনার কবিতা। যা শুধুমাত্র সময়ের নয় বরং কালনিষিক্ত প্রবাহের। তাৎক্ষণিকের নয়, অনাগত এবং বিগতের মিথষ্ক্রিয়া কবির
কবিতা, যেখানে চেতনার পরিধি অভ্যন্তরের সব সীমাকে ভেঙে দিতে
চেয়েছে দক্ষ, নান্দনিক উচ্চারণে।
ধন্যবাদ
উত্তরমুছুন