
কবির নাম, বয়স, লিঙ্গ, ঠিকানা ইত্যাদি যা কিছু কবিতার জন্য জরুরি নয়, তা আমরা মুছে দিয়েছি। আর এভাবেই ১০টি কবিতা পাঠানো হয়েছে অন্য এক কবির কাছে- আলোচনার জন্য। শুধু ১০টি কবিতা, আগে পরে নাথিং। আমাদের সাথে রুমালচুরির এই খেলা খেললেন ১৯ জন কবি।
এখানেও কবির নাম ছাড়া ১০টি কবিতা রাখা হল, সঙ্গে থাকলো আলোচনা। কবির নাম জানার রাস্তা কবিতার নীচ দিয়ে গেছে। তবে আমরা বলবো রুমালচুরির এই খেলায় আপনিও থাকুন। কবির নামটা না হয় একটু পরেই জানলেন।
১০টি কবিতা
দেখাশোনা
১.
দুই আর তিনে কত হয়?
তেইশ
আমরা বন্ধু হলাম। খাতায় নেমে এল উত্তর। আমরা এরপরে
নদির ডাক শুনলাম
তেইশ
চব্বিশ পঁচিশ
আমরা পেরিয়ে যাই। বন্ধুকে বন্ধু ভাবি, যেমন মা’কে মা..
২.
এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে, খুব জোরে হাঁটছি, ট্রেন আসবে
আসবেই
বোতাম লাগানোর শব্দ
শিশির পড়ার
শব্দে
ভোর থেকেই আমি আর কিছুই জানিনা, ট্রেন আসবে আসবেই
এখানে খড় আর আকাশ
শিঙা আর দামামা, নাচ আর মদ ছিল
এখন স্টেশন হয়েছে
আর ট্রেন, কেন আসবে না, আসবে
এসে চলে যাবে...
৩.
আমরা বন্ধু, আমাদের জামার রং কি ছিল মনে নেই
সিঁড়ি যেমন হয়, গোধুলি লাগানো
আর উপরে তৃণা রাত্রি ইলোরা...
তো এসব বাহানাই
ছিল, কত ঘুরলাম
আমি আর দিলু, দিলু আর আমি তারপর লাগালাম
আলাদা আলাদা
দিলু বলল, তারটা ছিঁড়ে গেছে তৃণা
আমি বললাম, ব্ল্যাকটেপ হবে ইলোরারাত্রি ইলোরা রাত্রি নয়,
ইলোরারাত্রি
সেদিন মেঘ এল, বৃষ্টি এল, আমি দেখলাম আর দিলুকেও দেখালাম
যে
স্টেডিয়ামটা তৈরি হচ্ছে, বাজ পড়ছে সেখানে
তার
ব্ল্যাকটেপ
রাত্রি ইলোরা তৃণা কেউ নেই, আমি আর দিলু , শুধু দিলু আর আমি
খুব ভিজেছিলাম
মাসখানেক পরে খুলে দেয়া হল স্টেডিয়াম
আমি আর দিলু, আমাদের গায়ে বাজ-পড়া জামা, চললাম
আমার অ্যাটলাস
দিলুর হারকিউলিস ,দুজনেরই সাইকেলে ব্রেক নেই
বাঁদিকে...
৪.
নেভিব্লু জিন্স আছে, নীরবতা আছে আর শুঁয়োপোকালাগানো শীত
ইউসেবিও না পেলে
বন্ধুরা খুব জোরে কথা বলছিল, পেলে না ইউসেবিও
নীরব ভেঙে গেল
সিপিএম না কংগ্রেস, ভেঙে গেল যে নীরবতা সেখানেই চায়ের দোকান
অলস শুঁয়োপোকা আর
চঞ্চল প্রজাপতির ভেতরে আমরা
নেভিব্লু আমরা, থ্রি স্পেড ফোর হার্টস, আমরা
মন আছে প্রজাপতির?
মনে পড়বে শুঁয়োপোকার গা ভরা শীতের দিনগুলোয়
টয়লেট ওয়াশরুম না, বাথরুম ছিল আমাদের, পেলে না ইউসেবিও
ইউসেবিও না পেলে ক’রতে ক’রতে..
৫.
বাদামি আর নিঝুম, দরজাটা
সূর্য নেমে যেত
শদ হতনা, বেড়াল?
কি আছে ওপারে, না ভেবেই কাঁধে হাত রাখতাম
এপার ওপার দেখা যেতনা
দরজা ছিলই না, তাহলে নক করার শব্দগুলো, নেমপ্লেটের সান্যাল
শব্দটা...
দরজা দরজা করে চেঁচিয়ে
দরাজার কাছে ফিসফিসিয়ে বলতাম নিঝুম, ভাবতাম বাদামি
দিগন্তে হঠাৎ পড়ে যেত, কোন শব্দ হতনা
কোন হাড় ছিলনা, আজো নেই সূর্যের..
৬.
রাত হলেই রাত, গল্প ঘুমোয়, চাঁদ একটা কোচ তখন, সুতো ছাড়ে জ্যোৎস্না
রাত হলেই
ব্রিজ আমাদের বালানন্দিত, আমি ফুঁকে দেখেছি, আড়ে সে তাকায়,
আর যারা
দেশের জন্য নিবেদিত
পতাকা তোলে
রাতের কি আর হবে, কয়েকটা চাদর, বালিশ, নহি নহি অভি নহি
কোচ বদল ক’রে আরেকটা চাঁদে
আমি যাই, ব্রিজের গোপন আলোচনা পড়ে থাকে
পরে থাকে জোছনা টোছনা
গল্পে বাঘ আসে, শোঁকে, নখ ব্যবহার করে, আমরা ছিটকে বেরোতে
চাই
পারিনা
৭.
ব্রিজ পেরিয়ে চলে আসি
কাঠগোলা, পাশেই নালেখা রাস্তা, রোজ রোজ যেখানে ধুলো ওড়ে
রাইফেল, ওর নাম
আমাদের কয়েকটা নাম উড়ে গেল, যেদিকে পলাশবাঁকা রাস্তা
ও বলল
আমরা শুনলাম, মাঝখানে সরু বিবাগীমত নদি
বেঁচে আছে
ওর দুঃখ
আর আমাদের ব্রিজপেরনো আনন্দ গনতন্ত্রে যেমন হওয়ার কথা, হলনা
চোখ আর জল, হলনা
সামান্য জল পড়লে হয়ত রাইফেল জিগগেস করতো না, বন্দুক হ্যায়
আপকে পাস
আউর
গোলি...
৮.
তুমি চাঁদ আঁকো, চাঁদ তোমাকে
আমি আর দেখিনি যে পাংচার সারাবার পরে কে বেশি আঁকা
টু-টায়ার চাঁদ
না আমাদের মুন মুন মুন মুন মুন্নী
হাত দিয়েই মনে হল অ্যালার্ম
দেখিনি যে দেখিনি কে এই বোঁটাশুদ্ধ আবহাওয়ায় রাখলো
বিভিন্ন সাইজ, আঁৎকে ওঠা
আরো নানাধরণের মার মার কাট্ কাট্ চাঁদনি, আমি হাত
রাখি, কি যে মহাভারত মনে হয়...
মনে হয় আঁকার পরেও কত কি ফুটছে, খ’সে পড়ছে...
দূর নিয়া-১
পেরিয়ে এসেই দেখা গেল ওদিকের ‘মজুরি চাই’ বা ‘দিতে হবে’
এদিকে শিসছাড়া ক্রিং ক্রিং, সব না বুঝেই পাখি এত বিশারদ, দুনিয়াভরানো হাতে
ক্রমবিকাশের ডাক, বলল, আরে তুমি....নাও ধরো থিওরি অফ ইভোলিউশন...খুঁজছিলে না?
পাখি ডানা আর বাহানা মিলিয়ে ওড়াকে করলো নিঝুম, সন্ধ্যায় কি
আর হবে, গান ভেসে আসে, শিফট-ভাঙা দেদার
ক্লান্তি এসে পড়ে, ওড়া এক শানিত অভ্যাস যদি বাইসাইকেলেই টানা বিকেলের বয়ে যাওয়া
বয়ে যাওয়া আমার দিকেই ফের এক সিলি সিলি কোনাচে বার্তা, মানে
বই নেই, না?
পৃথিবীর শস্য আছে, শস্যে মজুরি, মজুরদের লম্বা মিছিলে নেমে
আসা বুর্জোআকাশ, মেঘ হয়, দীপক সিনেমার কাছে সামান্য ঘাম, অসামান্য হীরে হ’তে হ’তে
নাকের পাটায় পড়ো পড়ো
পাশে
ফোল্ডিং ছাতা খোলার অবসরিকা তিল, এও কি আমার হবে সমান মজুরি হবে যেদিন লালফৌজের
পেশিতে পেশিতে লেনিনের সান্দ্র নাদেঝদাও এক মানে না-মানা পাখিদের পাখিরা
বিপ্লবও হয়ে গেল, এই গোধুলিবেলায় রেনকোট আর ছাতার আবেগ
সামলে এবারে ঠিক হোক পাখি আর কতদিন আকাশে উড়বে
সাইকেলের কি হবে, ফাঁকা কেরিয়ারের কি হবে....পাখি ব’সবে না
একদিনও?
দূর নিয়া-২
চ্ছলচ্ছল টিহট্টি কুবো কুবো
দীপ্রহারা দুপুর
পাশে এক চাপা কনীনিকা, দারুচাঁপা রং
সব দেয়ার পরে
আবার লাগাতে বললো, এ ব্যথা কি যে ব্যথা
দুপুর হ’লে
আজ কেন কালও মনে হত, শায়িতা যে ছিল আচমকা
সে কিভাবে জানলা খুললে
লজ্জা মিশতো দেরাজহারা রোদে
একেকটা খ’সে পড়া
র
দুপুর থেকে
পুর থেকে
র থেকে রিয়া যেন না হয় আবার
আমায়
সব্জেদূর সাইকেল কিনতে হবে
সাইকেল তো জানি, যে সময়ে সাঁতার জানিনা
কিন্তু সাঁতার এখনো কেন
আলোচনা করলেন উমাপদ কর
কী লিখব আমি?
এসব কবিতা পড়লে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে হয়। মুখে কথা সরে না। মাম হয়ে যাওয়া আর কি। তো তবু কিছু লিখতে হবে। তাই বার কয়েক পড়ার পর সত্যি দেখলাম আমি চুপ করে বসে আছি। আর আমার মধ্যে এক বিশেষ ক্ষরণ হয়ে চলেছে। বুঝলাম একটা জারণ ক্রিয়া শুরু হয়েছে ভেতরে ভেতরে। আমি মুগ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারছি না। হয়ত চাচ্ছিও না।
আরেকটা বিষয়ও খেয়াল করলাম— আমি এই ধরণের কবিতা আগেও পড়েছি অনেকবার। এ কবিতায় আছে এক বিশেষ সিগনেচার। চেনা যায় কবিকে তার চলনে বলনে আর ইঙ্গিতময়তায়। এখানে নাম নেওয়া বারণ, তাই কবির নাম নিচ্ছি না। কিন্তু বহুদিনের পরিচিত স্বর এটা। একে ভুলতে পারিনা।
মুগ্ধতা জানিয়ে শুরু
করেছিলাম। মুগ্ধতা জানিয়েই শেষ করব এ কারণেই যে এই লেখাগুলো শেষ পর্যন্ত এক অনাবিল
আনন্দ এক বিশেষ ধরণের মজা কিছু বিস্ময় আর প্রানময়তায় ভরপুর করেছে আমাকে। আমার
মধ্যে কবিতা জাগিয়েছে এখানেই এর সার্থকতা।
আরেকটা বিষয়ও খেয়াল করলাম— আমি এই ধরণের কবিতা আগেও পড়েছি অনেকবার। এ কবিতায় আছে এক বিশেষ সিগনেচার। চেনা যায় কবিকে তার চলনে বলনে আর ইঙ্গিতময়তায়। এখানে নাম নেওয়া বারণ, তাই কবির নাম নিচ্ছি না। কিন্তু বহুদিনের পরিচিত স্বর এটা। একে ভুলতে পারিনা।
কবিতা কি কসরৎ করে লেখা হয়?
বোধহয় না। কবিতা লিপিত হয়। কবি এক লিপিকার। তাঁর এক বিশেষ অবস্থানের অনুভূতিমালা লিপিত হয় আমাদের পরিচিত অক্ষরে আর শব্দে, শব্দ-বন্ধে আর ধ্বনিতে, কখনো বাক্যে কখনো অংশ-বাক্যে। আর সেই কবিতালিপি পাঠে ফের জাগরিত হয় আরও সহস্র অনুভূতিমালার স্ফুরণ ঘটিয়ে। কবিতাটি এক মাথা থেকে অনেক মাথায় প্রোথিত হতে থাকে তার সমস্ত সম্ভাব্য ব্যঞ্জনা সহ। কবি যখন ভাবেন “আমরা বন্ধু হলাম”
তখন সে ভাবনা চারিয়ে যায় আমার মধ্যেও। আবার কবি যখন সমস্ত বন্ধু-আবেশকে বিমোচিত করে শুনতে পান নদীর ডাক তখন আমার
‘তেইশ চব্বিশ পঁচিশ’ এই ডাককে এক উচ্চনাদের ধ্বনি বলে মনে হয়,
সাড়া দিতে ইচ্ছে করে। “বন্ধুকে বন্ধু ভাবি, যেমন মা’কে মা..” এক মাস্টার স্ট্রোকে বিমোহিত
হয়ে পড়ি। এলোমেলো পাঠ কোথায় গিয়ে যেন এক জায়গায়
মেশে আর ঝমঝম কবিতা বেজে ওঠে। একটা টুকরো একটা কুচি একটা মোচড় এই সব মিলিয়ে
এক কোলাজ ভাবনা বহু পরিসর খুলে রাখে আর আমি অন্তত তার মধ্যে সাঁতার কাটার প্রেরণা
জুগিয়ে ফেলতে পারি।
‘দেখাশোনা’ ১ থেকে ৮ এরকমই নানা ভাবনায় সংক্রমিত হয় আমার মধ্যে। যেন কবি কিছু বলছেন না, শুধু কিছু ভাবনার ইঙ্গিত রেখে যাচ্ছেন লিপিতে। প্রথম জীবনের সামান্য ছোঁয়ায় উদ্ভাসিত হচ্ছে দ্বিতীয় জীবন। রং রস দেখা শোনা সব প্রথম জীবনের। তা অন্ধকারে পা ফেলে আলোকিত করে তুলছে দ্বিতীয় জীবন, যে জীবনের সে অর্থে কোনো কামনা বাসনা নেই,
আছে শুধু প্রাপ্তি, অপার। “এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে, খুব জোরে হাঁটছি, ট্রেন আসবে/ আসবেই’। দেরি হয়ে
যাওয়া, জোরে হাঁটা, ট্রেন আসবে- এক সম্ভাবনা, আর আসবেই এক প্রত্যয়। আর কিছুই না
জেনে এই প্রত্যয় নিয়ে ভাবনাকে ছড়িয়ে পড়তে দিয়ে বোতাম লাগানোর শব্দ শিশির পড়ার শব্দ
ইত্যাদি শুনে নেওয়া এক আশ্চর্য ফ্যান্টাসির জগৎ। ‘আর ট্রেন, কেন আসবে না, আসবে/
এসে চলে যাবে...’ এ এক কঠিন বাস্তব। আমাদের মাঝে মধ্যেই তো দ্বিতীয় জীবন থেকে নেমে
আসতে হয় প্রথম জীবনের বাস্তবতায়। দেখা শোনাকে একবার মিলিয়ে নিতে। কবির এই দু-একটা ভাবনার আঁচড় ছোট ছোট করে
বলা এক সময় আমদের নিয়ে চলে যায় এক গভীর অনুভাবনায়। ট্রেন আসবে, এসে চলে যাবে, কেননা এক সময় যা স্টেশন ছিল
না এখন স্টেশন হয়েছে, সেই স্টেশনে ট্রেন আসবে। আর স্টেশন মানেই হলো ট্রেনের আসা আর মন খারাপ করে চলে যাওয়া। এক বিবশতা নিয়ে মাম হয়ে যেতে হয়।
তৃতীয় কবিতায় এক ধরনের বলে
যাওয়া আছে কবির, অনেকটা রিলে করার মতো। আছে ডায়লগ। কিন্তু কোথাও কবিতার মাত্রা কমে গিয়ে নাটকে পর্যবসিত
হয়নি। রিলের মতো বলে যাওয়াটা বর্ণনার লাগামছাড়া দৌড়ে পৌঁছয় নি। নির্মাণের মধ্যে এমনই সব ভারসাম্যে কবিতা কোথাও গিয়ে একটেরে হয়ে ওঠেনি। ‘আমরা বন্ধু,
আমাদের জামার রং কি ছিল মনে নেই/ সিঁড়ি যেমন হয়, গোধুলি লাগানো’। এটুকুতেই একটা
কবিতার আলতো চলনের আভাস। তারপর রাত্রি তৃণা ইলোরা আমি দিলু তার-ছেঁড়া ব্ল্যা্কটেপ
বৃষ্টি বাজ-পড়া স্টেডিয়াম ইত্যাদি পেরিয়ে তেমন কোনো ঘটমানতায় না থেকে যখন “আমি আর
দিলু, আমাদের গায়ে বাজ-পড়া জামা, চললাম/ আমার অ্যাটলাস/ দিলুর হারকিউলিস ,দুজনেরই
সাইকেলে ব্রেক নেই/ বাঁদিকে...” তখন এক চলমানতায় আমরা যেমন গতিশীল হয়ে পড়ি তেমনি
মাঝের ওই টুকরো-টাকরায় এক বিশেষ ধরণের মজাও উপলব্ধি করি। কবিতায় এই যে এক মজা, যা
আজ কবিতায় দুস্কর, তাই এই কবিতার
প্রাণ আর কবির সিগনেচারও।
প্রথাবহির্ভূত এই কবিতায়
এক জল তরঙ্গের টুংটাং আছে। আর তার স্কেল ও মাত্রা বহুবিধ। কখনো খুব নীচে, কখনো বেশ
ওপরে আবার মুহূর্তেই মাঝামাঝি কোনো এক জায়গায়। “নেভিব্লু জিন্স আছে, নীরবতা আছে আর
শুঁয়োপোকালাগানো শীত” কবি যখন বলেন তখন জলতরঙ্গে যে কম্পাংকের সৃষ্টি হয়, অচিরেই
তা ভেঙে অন্য এক কম্পাংকে বেজে ওঠে জলতরঙ্গ যখন আমরা বেজে উঠি “ইউসেবিও না পেলে/
বন্ধুরা খুব জোরে কথা বলছিল, পেলে না ইউসেবিও/ নীরব ভেঙে গেল”। আবার পরিবর্তিত হয় তার টুংটাং যখন কবি এক আপাত নিরীহ সামাজিক কথা তুলে জানাতে
চান “সিপিএম না কংগ্রেস, ভেঙে গেল যে নীরবতা সেখানেই চায়ের দোকান”। এভাবেই এক
গীতল পরিবেশ রচনার মধ্যে আমরা সাঁতার কাটি আর কবিতার সঙ্গে ওতপ্রোত হতে থাকি। একসময়
সেই জলতরঙ্গের কম্পাংকের সঙ্গে আমাদের হৃদতন্ত্রীর তরঙ্গ মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়
এক মধ্যমানের স্কেলে যখন লিপিত হয়—“টয়লেট ওয়াশরুম না, বাথরুম ছিল আমাদের, পেলে না
ইউসেবিও/ ইউসেবিও না পেলে ক’রতে ক’রতে..”।
তুলে ধরলে ৫ নম্বর কবিতাটা
গোটাটাই তুলে ধরতে হয়। তা থেকে বিরত থেকে বরং এই যে কিছুটা বাদ দিয়ে কিছুটা দিয়ে
আলোচনা তা সম্পূর্ণ হয় না, এমনই গুণ এইসব কবিতার। দেখা ও শোনা কবির। তাতে ভরসা
করেই দেখানো আর শোনানো। বাদামি রঙের দরজাটা দেখতে হয় আর নিঝুম দরজাটা শুনতে হয়।
দরজাও শোনা যায় যখন সে নিঝুম হতে পারে। সূর্য নেমে যায়। শব্দ হয় না। পরমুহূর্তেই
প্রশ্ন— বেড়াল? একটি প্রশ্নেই উপমাটা কত সহজেই তার প্রথাগত রূপ পালটে ফেলল। তো,
এসবই এই কবিতারাজীর বৈশিষ্ট। ‘নেমপ্লেটের সান্যাল শব্দটা’ আমাদের এক ঝলকে দেখিয়ে
দেওয়া হয়। আর শোনানো হয় দিগন্তে সূর্যপতনের শব্দ। “দিগন্তে হঠাৎ পড়ে যেত, কোন শব্দ
হতনা/ কোন হাড় ছিলনা, আজো নেই সূর্যের..”।
এভাবেই দেখাশোনা ৬ ৭ ৮ কবিতাগুলিও
অনেকটা খুচরো কথকতার ঢং এ এগিয়ে চলে। খুচরো বললাম এই কারণেই যে কবিতাগুলোর
চলনে আপাত লিংকবিহীন কথা তথা পঙক্তি বা বাক্য সন্নিবেশিত হয়েছে। আবার কখনো পুরোনো লিংক-এ ফিরে এসেছেন কবি। দুটো পঙক্তি বা দুটো বাক্য বা বাক্যাংশে এত স্পেস ছাড়া আছে যে পাঠক সেখানে সম্ভাব্যতার
সমস্ত দিকগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে পারে। কবিতা ভ্রমণে নিজস্ব পাল তুলে
দিয়ে দাঁড় বাইতে পারে। কবিতা কোনো রিজিড জায়গায় আটকে থাকে না। ভীষণই ফ্লেক্সেবল তার চলন। এভাবেই অনেক সম্ভাবনার মধ্যে
চলাচলের মাধ্যমে আমরা প্রথম দেখাশোনার জীবন থেকে অন্য এক দেখাশোনার দ্বিতীয় জীবনে পৌঁছে
যেতে পারি নিজেদের ভাবনার সম্প্রসারণে।
‘দূর নিয়া’
কবিতার নামেই ধ্বনির একটা খেলা আছে। শব্দটি
তৈরি করা। একটি শব্দজোড়। এই কবিতা
দুটোতে এমন আরও কিছু শব্দ আছে। কখনও শব্দজোড় আবার কখনও শব্দ
ভাঙা। যে কবিতা এই কবি লেখেন তার সবসময় শুধু এই প্রচলিত শব্দে কুলোয়
না। তখনই মজা করতে করতে এই সমস্ত শব্দের অবতারণা। এতে ভাষায় একটা আলাদা মাত্রা যুক্ত হয়। আর পাঠককেও একটা বিস্ময় ও ভালোলাগায়
আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে হয়। কয়েকটা উদাহরণ তুলে ধরলে মন্দ হয় না। ‘বুর্জোআকাশ’, ‘
দীপ্রহারা’, ‘দারুচাঁপা’, ‘দেরাজহারা’, ‘সব্জেদূর’ ইত্যাদি। আবার ‘একেকটা খ’সে
পড়া/ র/ দুপুর থেকে/ পুর থেকে / র থেকে রিয়া যেন না হয় আবার’ এ শব্দ ভাঙার খেলা।
তো এগুলি সবই যে ধারায় কবিতা লিপিত হচ্ছে সেই ধারার টুলস্ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এরকম অনেক টুলসের সমন্বয়ে কবিতাগুলো নির্মিত।
সবশেষে কবিতাগুলোর সাধারণ
কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। ক) বিষয় এখানে অবান্তর তাই বিষয়ের কোনও ভার
নেই। খ) কোনও নির্দিষ্ট যুক্তিক্রম নেই কবিতার চলনে তাই ছড়িয়ে পড়া আছে আপাত
বিশৃঙ্খলায়। গ) বিন্দু ভাবনা থেকে যেমন ছড়িয়ে পড়া আছে তেমনি কখনও ছড়ানো থেকে আবার
বিন্দুতে সমাপতনও আছে। ঘ) কোনো বানী নেই, কিছু বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য করে তোলার
তাগাদা নেই, ফলে এসবের কোনও ভার কবিতাকে বইতে হচ্ছে না, একটা তরলতার মৃদু ঢেউ-এ
কবিতাগুলো আন্দোলিত। ঙ) পর্যায়ক্রম না থাকায় শুরু যেমন শুরুর শুরু শেষও তেমন যেন
আরও নতুন কোনও শুরুর মহড়া। এক কথায় ওপেন এণ্ডেড। চ) প্রথাগত কবিতার মতো এখানে কোনও
উপমা রূপক চিত্রকল্প ইত্যাদি নেই। যা সামান্য কিছু ছিন্নভিন্ন ছবি আছে তা কল্পনায়
বোনা যাকে সহজেই কল্পচিত্র বলা যেতে পারে।
কবি উমাপদ আমার বন্ধু, কিন্তু উমা'র মত কবিতামনস্ক মানুষ এই বাংলায় হাতেগোনা কয়েকজনই আছেন। উমা'র আলোচনা আমায় বরাবরি সাহস যোগায়। লেখার জ্বালানি যুগিয়ে দেয়। ভালবাসা, বন্ধু!
উত্তরমুছুনভালবাসা স্বপন দা। কবিতায় থেকো, ভালো থেকো, পাশে থেকো।
মুছুন