রুমালচুরি- ৪



  

       কবির নাম, বয়স, লিঙ্গ, ঠিকানা ইত্যাদি যা কিছু কবিতার জন্য জরুরি নয়, তা আমরা মুছে দিয়েছি। আর এভাবেই ১০টি কবিতা পাঠানো হয়েছে অন্য এক কবির কাছে- আলোচনার জন্য। শুধু ১০টি কবিতা, আগে পরে নাথিং। আমাদের সাথে রুমালচুরির এই খেলা খেললেন ১৯ জন কবি।


       এখানেও কবির নাম ছাড়া ১০টি কবিতা রাখা হল, সঙ্গে থাকলো আলোচনা। কবির নাম জানার রাস্তা কবিতার নীচ দিয়ে গেছে। তবে আমরা বলবো রুমালচুরির এই খেলায় আপনিও থাকুন। কবির নামটা না হয় একটু পরেই জানলেন।




  ১০টি কবিতা



রাজার মতো রাজা

সেফটিপিনের ডগার উপর ভর করে পেরিয়ে যাচ্ছে দিন
একাই একশ হচ্ছে আরকাচে-জলে ঝাপসা 
একা হাতে ঘুরিয়ে দিচ্ছে বাবরি, ভাবছে  
রাজার মতো রাজা এতদিনে মরেছে চাপা পড়ে 

যাচ্ছ তো যাচ্ছ কেন হারালে না একটিবারের জন্য
অন্য অন্য বাড়ির উপান্তে মরুভূমি কত সুন্দর
কেন সেরকম কোনও গান হলে না
হে আমার উজ্জ্বল দিন, তেমন হাতে খুললে
তুমি কি তোরঙ্গটুকু দেবে খুলে প্রাণাধিক 

ভূতের সফর

বাণী বসে গেছে, গলাও। কিছুই আর তেমন কাজে আসে না
পূর্ণছেদকে জড়িয়ে একটা ভীষণ হুলুস্থুলু ইচ্ছে করছে,
নুন দিয়ে নিজেকে আধপোড়া আর পায়ের কাছে
পিষে যাওয়া ইচ্ছে করছে।

আমার নবীন দেখে তুমি কী এর বেশি ঈর্ষা করো? কী হয়েছে
ঠিকমতো বুঝলে আমিও হইহট্টে যেতাম না। কিছুদিন যাবত
একটা ভিডিও ফুটেজে এরকমই দেখা গেছে
সারাদিন চেয়ার নড়ছে,
টেবিল টানছে কোনও এক ভূতের আত্মা।

তুমি-রতি

বাক্য ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে
কেন লিখছি না যন্ত্রপাতির অভ্যুত্থান নিয়ে
এসব কথা এমনকি দূরে নিয়ে যাচ্ছেঅনেকদূর
আমাদের যে অতীত গেছে কারাবাসের ভেতর চুরি করে

কীতেমন কিছু বলার মতো নয়
এই লেখাও তেমন কোনও বড় কাজ আর নয়
আলো বসে যাওয়ার আগে
কেবল কতিপয়ের গলা সাধা, ইন্দ্রিয় অর্জন
নিখুঁত অথবা এলোপাথাড়ি নখ কাটা
একটা নিরীহ ফলের সামনে যতপ্রকারে সম্ভব
মূর্ছা যাওয়া 

বসন্ত-পর্যায়

নেপথ্যের কন্ঠ রেকর্ড প্লেয়ারে চলতে ভুলে গেছে
আমরা যারা সূত্রধর সেই থেকে স্থির, নড়ছি না
শুরুর শুরু নেই দেখে এমনকি প্রেক্ষাগৃহ স্টিল হয়ে গেছে

গোটা জগৎসভা আমাদের দিকে হাঁ হয়ে পাথর হয়ে যাচ্ছে
আমরা দেখছি, যেতে দিচ্ছি। কেউ বুঝছে না শুরু এমনকি
আর সূত্রধরের হাতেও নেই।

 যাহা কিছু ঘটে আছে

এখন রাত শেষ করে দিন, না দিন শেষে রাত্রি, এই চিন্তা
ফুঁ দিয়ে নামায়। আমার পরবর্তী তিরিশ দেখি হেসে খেলে
গড়িয়ে নেয়। মজা করে ও বুদ্বুদ ছড়িয়ে রাখে। কিছুতেই
সে পুরোটা মনে পড়তে দেবে না। মজাদের গা থেকে আঁশ-
ছাল ছাড়িয়ে নেয়। ও বৃহৎ দংশনের ছবিতে একটা দাঁড়কাক
কী অসম্ভব রতিময় দেখায়। ওহ্‌ কী গা-ভর্তি দাঁড় বাওয়া

ধরে নেয়া যায় এর ঠিক পক্ষকাল পরে পৃথিবীর ঈর্ষা পূর্ণ হবে। 
আমাদের মানুষের মতো সেও একটু একটু প্রলুব্ধ হবে। আর সে
রসনায় বাড়ি বয়ে চাঁদ আসবে পায়ে হেঁটে। বলবে চিমটি কেটে
দেখোও  দেহ সত্য কিনা! 

সব ঝিঁঝি হয়ে গেছে 

তোমার বাসনার ভিতর, জ্বলে আছেসে দূরের কুপি রেখে দেখো
দেখো জ্বলে জ্বলে কালি পড়ে কিনা। আপাত মাধুর্যের কাছে এসে পড়ে 
দেখো, তার সম্রাট তখনও বাকি রয়ে গেছে কিনা। শুধু সন্দেহের বশে
সে দরজা পেরিয়ে কান পেতেছিল। তাতে সব ঝিঁঝি হয়ে গেছে।
কুকুরও ঝিঁঝি। রাতের জনহীন বাইকও ঝিঁ ঝিঁ।

কেউ বিশ্বাস করবে নাএতটা শব্দের ভিতর, ক্রমে স্বাভাবিক হয়
বাজুতে নৈশশিস্‌ ওঠে, যে দৃশ্যত কোথাও নেই, তার ছায়া হেলে পড়ে
যখন সম্রাট বাকি পড়ে আছে, এও স্বাভাবিক বলে মনে হয়। 
অতঃপর যুক্তির ছাদ ওঠে। একে একে হাত-পা-মুখ-মাথা ঘুমে কাদা
ঠিক তখনই তোমাকে অসাড় রেখে
তুমি বেরিয়ে আসছ কুপি জ্বেলে।

তোমাকে কি তবে আহত করেছেআর কেউ   

 যতটা আখ্যান, যতটা নয় 

বাজারে যাব না যাব-না এই দোটানার ভিতর বার তিনেক
চা শেষ করি। একটা আখ্যান মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে
বৃক্ষের দীর্ঘ কাটানো জীবন। ও আলোয় চোখ জ্বেলে সহসা
আবিষ্কার করি, তার ভাবনায় কেউ আটকে আছে। উঠে গিয়ে
জল দিতে হবে। ভাবি হয়ত এই না-লেখাতেই বারোটা-একটা
বেজে যাবে।

কাব্যে উপেক্ষিত তর্জনী ধরে ধরে বহুদূরে একটা সানাই
রোগা হেঁটে বেড়াবে। যারা বিবাহিত, যারা নয়সবার জন্য
একটাই রাগ বাজবে অনেকক্ষণ ধরে। 

সমস্বর

পৃথিবীর গায়ে টেরিকাটা গাছ
আজ সমস্বরে সা গাইছে
যত পাখি সব খোঁচাখোঁচা রাগ আঁচড়ে
এ ডাল- ও ডাল মিলিয়ে দিচ্ছে

কে কাকে গাইছে, ভাবি
গাছ তোমাকে, না তুমি গাছকে

অসহ্যে মাতিয়ে রেখে আজ সারাদিন
বকবকম হয়ে আছে
শুধু পালক রয়েছে
পায়রা কোথাও নেইসেই দোষে
দোষী হয়ে আছি

ওটুকু বইতে দাও

সব কাছের জনপদ থেকে তুমি পরিত্যক্ত
হয়েছ এমন যেন বাহাদুর থেকে বাঘ এসেছে ফিরিয়া
যে পারছে না তাকে সামলে দাও

সবেমাত্র মাংসের প্রহর, তাকে ওটুকু বইতে দাও

ভেংচি

পুরোটা মনে আসছ না, তবে কি পেশীতে, শরীরে
অন্তত কোনও ভাঁজে ঢেউ কিংবা খাদের মতো অপেক্ষা করছ?
নেই হাওয়ায় পাতা নড়লে, ভূত নয় নিজেকে কিংবদন্তী লাগে
ও উহ্য তোমাকে রপ্ত করার আকাঙ্ক্ষায় থাকি

চারিদিকে চরিত্ররা বাজারে যায়, পার্স খোয়ায়
বাঁকের কাছাকাছি এসে দেখি কেউ বা হাঁটা নকল করছে তোমার

অনুসরণ করার দূরত্বে এলে দেখি কোথাও আসল নেই
তোমার তুমি-ই নেই
এই লেখাটুকু হবে বলে পেশীতে বসে ভেংচি কাটছিলে 




  সম্ভ্রম-জাগানো কবিতা
আলোচনা করলেন অংশুমান কর  

 শুরু এমনকি
        আর সূত্রধরের হাতেও নেই

       এই লেখাগুলির মূল সুর এটাই। শুরু-শেষ কারও হাতে নেই। বাংলা কবিতা লেখার এটা একটা ধরন। একসময় আমিও কিছুটা প্র্যাকটিস করার চেষ্টা করেছিলাম। এখন দূর থেকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখি।

       যুক্তির সোজা-সাপটা যে ব্যবহারে কবিতা-পাঠক অভ্যস্ত সেই ব্যবহার এইসব কবিতায় থাকে না। দিগন্তের কাছে নিয়ে গিয়ে এই কবিতা পাঠককে বুঝিয়ে দেয় যে দিগন্ত এক ভ্রম; তার নাগাল কেউ কোনওদিন পাবে না। শব্দকেও এই ধরনের কবিতা তার চেনা আখড়ার চেনা বালির বাইরে নিয়ে গিয়ে ফেলে। নতুন নতুন পালোয়ানিতে তাকে প্রতিনিয়ত আহ্বান জানায়। যেমন, একটি কবিতায় লেখা হয়েছে, ‘আমার নবীন দেখে তুমি কী এর বেশি ঈর্ষা করো?’ তো, বিশেষণের এই রকম ব্যবহার কেউ মেনে নেন, কেউ নেন না। আমার মেনে নিতে অসুবিধে তো হয়ই না, বরং সম্ভ্রম জাগে। শ্রদ্ধায় মাথা নিচু হয়ে আসে। সম্পাদনার কাজ করতে গিয়ে এই ধরনের কবিতা আমি ছাপি। বাংলা কবিতাকে সামগ্রিকে ধরা তো একজন সম্পাদকের দায়িত্ব। তবে পাঠক হিসেবে এ কবিতাকে দূর থেকে দেখি, এর কাঁধে হাত রাখতে পারি না। এই ধরনের কবিতার কাঁধ সাধারণত অনেক উঁচুতে থাকে। নাগাল পাওয়া যায় না।

       মাঝে মাঝে অবশ্য মনে হয় এইসব কবিতার কোনও কোনও পংক্তি বুঝি পথ ভুলে আমার পাশে এসে বসে পড়েছে। উঁচু কাঁধের কবিতাদের এইসব পংক্তিগুলির হাত কীভাবে যেন আমার হাতের নাগালে এসে পড়ে। মনে হয়, বুঝি আজ এদের অন্য কোথাও যাওয়ার নেই; মনে হয়, এদের সঙ্গীরা বুঝি এদের ছেড়ে অনেক দূরে এগিয়ে গিয়েছে। দৌড়ে পিছিয়ে-পড়া এইসব পংক্তিদের খুব চেনা লাগে। একটু পিছিয়ে-থাকা একজন মানুষ হিসেবে কাঁধ-উঁচু কবিতার এইসব পিছিয়ে-পড়া পংক্তিদের সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে যায়। আমি পড়তে থাকিঃ

সারাদিন চেয়ার নড়ছে,
টেবিল টানছে কোনও এক ভূতের আত্মা
বাঃ
বাজারে যাব না যাব-না এই দোটানার ভিতর বার তিনেক
চা শেষ করি। একটা আখ্যান মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে
বৃক্ষের দীর্ঘ কাটানো জীবন।
আবার কখনও বাঃ

চারিদিকে চরিত্ররা বাজারে যায়, পার্স খোয়ায়
বাঁকের কাছাকাছি এসে দেখি কেউ বা হাঁটা নকল করছে তোমার

       যত বন্ধুত্ব হয়, যতই আমি এই পংক্তিগুলির সঙ্গে সময় কাটাতে থাকি, ততই, মনে হয়, আগে-পরের চতুর, ঝকঝকে পংক্তিগুলির সঙ্গে বিচ্ছেদের বেদনায় তারা কাতর হয়ে আছে। আমি তাদের হাতগুলি নিজের হাতে নিই আর তারপর বলতে থাকিঃ “বন্ধু, তোমার হাতের উপর হাত রাখলেই আমি টের পাই তোমার বাজারে অনেক দেনা, ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে, মেয়ে রাত করে বাড়ি ফেরে, আজ যা-বলার আছে তুমি আমাকেই বলো, স্ত্রীর মুখরতার কথা বলো, সহকর্মীদের শঠতার কথা বলো, রাতে ঘুম হয় না সেই কথা বলো, আর যদি কাঁদতেই হয় তবে এই কাঁধে মাথা রেখে কাঁদো, বন্ধু”। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন