রুমালচুরি- ১২



  

       কবির নাম, বয়স, লিঙ্গ, ঠিকানা ইত্যাদি যা কিছু কবিতার জন্য জরুরি নয়, তা আমরা মুছে দিয়েছি। আর এভাবেই ১০টি কবিতা পাঠানো হয়েছে অন্য এক কবির কাছে- আলোচনার জন্য। শুধু ১০টি কবিতা, আগে পরে নাথিং। আমাদের সাথে রুমালচুরির এই খেলা খেললেন ১৯ জন কবি।


       এখানেও কবির নাম ছাড়া ১০টি কবিতা রাখা হল, সঙ্গে থাকলো আলোচনা। কবির নাম জানার রাস্তা কবিতার নীচ দিয়ে গেছে। তবে আমরা বলবো রুমালচুরির এই খেলায় আপনিও থাকুন। কবির নামটা না হয় একটু পরেই জানলেন।




  ১০টি কবিতা


   দোকানের কবিতা

নিঃস্ব রাত্রি অবশ দোকানঘরে
সবকিছুকেই দারুন লাগে দ্বিপ্রহরে
গল্প এবং গুজবমাখা দোকানঘরে
উলটে পালটে ঘাঁটছি আকাশ, অল্প পরে
বেরিয়ে যাব, তারার বাতির দাম বেশি না
আকাশ ভরা চাঁদ অবশ্য যায় না কেনা
পয়সা তো নেই, হাসির সঙ্গে লোলুপ চাওয়া
মাখিয়ে তুলি, এই তো তোমার দাম-না-পাওয়া
দোকানিদের পছন্দসই আলোকস্তম্ভ
তুলো গজের কাপড়মোড়া, হতভম্ভ

বৃত্তিমূলক হত্যে দেওয়া দোকানঘরে
সবকিছুকেই শোষন লাগে আড়ম্বরের।
জিনিশ জিনিশ প্রচুর জিনিশ, প্রাণ কেড়ে নেয়
অনেক পাব, অনেক পাব, পয়সা কোথায়
একটা গুনছি দুটোই গুনছি তিনটে কেনা
রাত্রি অবশ হলেই আবার প্রাণ বাঁচে না।
এবার ফেলি, পণের কড়ি, ছাড়ছি ক্ষিদে
নিজস্ব এক লপ্তে ফিতেয় দাও না বেঁধে

নিঃস্ব এবং রাত্রি অবশ দোকানঘরে
সবকিছুকেই তুচ্ছ লাগে কেনার পরে

আলমারি খালি করার পর

তোমার শৈশবের ক্রীড়াক্ষেত্র,
কৈশরের অবনত ব্রীড়াভঙ্গিমা
যৌবনের উপবন
উঠন্তি বয়সের খতরনাক মোহ
এই আলমারি।

শাড়িগুলি চলে গেছে, রেখে গেছে মৃদু নাভিশ্বাস।
মৃদু টাই ফাঁসদাগ রেখে গেছে যেরকম।
হার, ও কোমরবন্ধ অবিকল ঝোলানো থেকেছে
আংটায়। তুমি পালটে গেছ বলে মনে হয়।

বয়স বেড়েছে বলে নয়।
মৃত্যু দেখেছ বলে।
নিজের মৃত্যুকে নিজে দেখতে পাওয়া সহজ কঠোর দৃশ্য নয়!
শকিং এ মরে যাওয়া।
একদেশ থেকে যেন অন্য দেশে চলে যাওয়া
নিজ নিজ অভ্যাস উজিয়ে।
এই থাকা, এই না থাকার চিহ্ন ভুলে গিয়ে, অদ্ভুত
শিরশিরে।
আমার আলমারি জানে আমি কত টাকা জমিয়েছি, কুটিকাটি
আমার আলমারি জানে গোপন ড্রয়ারে আমি জমিয়েছি দারুচিনিদ্বীপ
আমার আলমারি জানে পুরোনো পোষাক, যারা
ছেলেবন্ধুদের মত একঘেয়ে। তাই ছেড়ে আসি।
আমার আলমারি জানে পুরোনো পাসপোর্টে আমি কতখানি নিদারুণ বোকা-দেখতে,
অনুভূতিহীন।

এইসব সব আজ খালি করে দিতে হয়।
এইসব আজ পরিস্থিতিগত পাল্টানোর পথে
একে একে ছেড়ে যেতে হয়।
ভালবাসা, তাকে ধরে আছে, তার মৃত্যু ধরে আছে।
জীবন, একের পর এক তুমি মৃত্যুদের বহন করেছ বলে
জেনেছি যে এই হল বেঁচে থাকা।
শাড়ীর পাড়ের মৃদু ঝুলে থাকা, রডে।
পালিশের দাগে দাগে অ্যাসিড ছোপের মত ম্লান মনখারাপ।

ড্যাঞ্চিবাবুদের গল্প

তোমরা ছিলে ফিলথি রিচ
আমরা ছিলাম নীল পিরিচ
              মধ্যিখানে ফাটা
তোমার ছিল আলুর দম
আমার ছিল ঝমরঝম
            রেলপুলের ঢেউ কাটা
তোমার ছিল বনমোরগ
আমার ছিল বুকের রোগ
           উনুনে দিই ফুঁ
তোমার ছিল হুলুস্থুল
আমার ছিল ক্ষতের হুল
           রক্তমাখা থু
একটা ছিল শৈলাবাস
একটা ছিল বাংলো, ঘাস
           কাটতেছিলাম আমি
একটা এল গাড়ির ঝাঁক
অনেক ছেলে মেয়ের হাঁক
           টুরিস্টেরা, দামি
এই সকলের কল্পনায়
একটু আধটু গল্প চাই
          তাই ত কেয়ারটেকার
তোমরা ছিলে ড্যাঞ্চি, বাপ
আমরা ছিলাম আদিম-ছাপ
         কেউ ছিল না মধ্যেখানের ফাঁকটুকুকে দেখার! 

দামিনীকে

আমানত নাম দিয়েছে কেউ
কেউ নাম দিল অনামিকা,
তোমাকে দেখিনি, দেখেছিও
তুমি তো আমারই অনধিকার...

কেউ বলেছিল বেচেরা মেয়ে
কেউ বলেছে ‘কী কষ্ট! ইশ!’
‘বেঁচে থাকলেও জিন্দা লাশ’...
লোভী চোখ চাটে চেয়ে চেয়ে

ওরাই তো মৃত, হাসপাতাল,
ওরা ফিনাইলে ভেজানো পাট,
ন্যাতা নিজেরাই, নারী-পুরুষ
জ্যান্ত নয়, ওরা বিছানা খাট।

অলিগলি পথ, সাদা আলো,
সাদাটে বিছানা, জানে না কেউ
এ ফোঁড় ও ফোঁড় লোহাগুলো
কত জংধরা? ব্যথার ঢেউ

কতখানি? আর প্রোটেকশান
যার কথা বলি অবান্তর?
কতটা শান্ত-ভাল-ন্যাকা
ডেটলচোবানো মূল্যমান...

রক্ষনশীল তন্ত্র এই
কতটা ঝামা ও পচনশীল
শুধু এক দুই দামিনীকে
শুঁকে নিতে হয় পুরুষ খিল

সব মেয়েদের বরাদ্দই
ঘৃণাময় কিছু অত্যাচার,
চোখে চোখে কত বলাৎকার
ভয়ে ভয়ে থাকা বয়সকাল

শুধু একটুর জন্য কেউ
রেপড যে হইনি, সে ভাগ্যেই
আমাদের ছুঁয়ে গেছে গালিই,
কামুক নজর, নোংরা হাত।

তুমি সবটাই নিয়েছিলে
আমানত তুমি ধ্বংস নাও
আমাদের হয়ে, আমার হয়ে।
একলা একলা মৃত্যু খাও

নীরবতা নয় দু মিনিট,
চীৎকার আজ পালন হোক
পুরুষহিংসা নয়, কেবল
ধর্ষক নামে আগ্রাসক

তাঁকে মুছে দাও নরদানব
পুরুষেতর সে, ক্লীব মানব
দামিনী, আজকে প্রান দিয়ে
বদল আনছ ভারতময়।

আমি নাম দিই মোমবাতি
তোমার থেকেই আরেকটি
তাঁর থেকে আরো। জ্বলবে ঢল
মোমবাতিদের। পথ হাঁটি...

এখন

দ্বিপ্রহর গতপ্রায় দ্বিপ্রহরে কটা হল ভুল
এই মাঝদরিয়ায় দেখা যায় না একূল ওকূল...
এতদূর এসেছিলে জীবনের নিজস্ব নিয়মে, পথ কেটে গেল হাওয়ায় উদবেল, রংচঙে
এখানে থেমেছে নৌকা, চলবে না স্রোতে, আহা, চলবে না স্বতঃস্ফূর্ত ঢঙে
এবার বাইতে হবে। খাটতে হবে। পরিশ্রান্ত হতে হবে খুব
এখন যা পারো করো, এর পরে জীবনের নিজস্ব বক্তব্য নাই। জীবন নিশ্চুপ।
এই পথ কষ্টের। বেদনাবাহিত, যেন কাঁদার বিরাম নেই কোন।
যদিও কেঁদেও কোন লাভ হবে না, কেউ গায়ে হাত বোলাবেনা এটা জেনো।
এই পথ হাওয়াহীন, তরী অবলীলাভরে চলবে না স্নিগ্ধলঘুবায়ে।
এ সমুদ্র গুমোট, ও ঢেউহীন... এ সমুদ্রকে কে বা থাকতে চায়।
এর পর থেকে পথ ধূ ধূ মরু। ভালবাসা নেই কোনমতে।
চলে গেছে রতিস্মৃতি, আনন্দের রেশম মসৃণ ধারা প্রথম প্রহরগুলি গতে।
এই পথ একলা একলা পার হবে। হাতে রইল কৌপিন সম্বল।
এই পথ হীরালাল মধুকর যদুভক্ত সকলের চলতে হয়। এরকমই চল।
নতুন দেখবে না তা তো বলছি না। নতুন তো আসবেই, এসেই চলবে সে।
তবু এই পথ শুধু ছাতহীন ঘর আর নুনহীন অন্ন... যাতে কান্নাজল মেশে।
নিজের কান্নার নুনে নিজের ভাতের গ্রাস গেলো।
নিজের জীবন তুমি নিজের হতাশা দিয়ে ঝেলো।
এখন অলৌলিক আনতে হবে নিজে খাল কেটে, নয়ত আকাশের দিকে হাত পেতে।
শান্ত সংযত হয়ে রবে ওহে তুমি অবিশ্বাসী, নশ্বর, হাভাতে!

বয়স

১.

ভালবাসার আলোময় কাজ, ভালবাসার আলস্যময় অন্ধকার খোঁজ।
তারপর পেয়ে যাও।
তোমার কর্মক্ষমতা বাড়ছে,
তোমার স্পর্শবোধ তীব্র হচ্ছে।

তোমার সামনে আলো, দেওয়াল, তুমি স্পর্শ কর।
তোমার পেছনে অন্ধকার, কালোরং করা টিন, চোখ দিয়ে চেটে খাও।
হাতে সামান্য চটচটে বোধ, ওষুধের শিশির গায়ে পিছলে যাচ্ছে মধু।
হাতে সামান্য খসখসে বোধ, এই সকাল শীতের, হিমের, চামড়া শুকিয়ে আসার।

এই সব সহ্য কর, সহ্য কর।
আজ আর অসহ্যতা নেই, সরে আসা নেই, থাকা আছে।
তোমার ক্ষমতা বাড়ছে, বোধ তীব্র হচ্ছে।

২.

বয়সের সঙ্গে তোমার সব কিছু বড় হয়ে ফুলে উঠে
ছাতার মত ঘিরে নেবে, তুমি ‘না’ করবে না আর কাউকে
অথবা ছোট ছোট ‘না’-এর দরকার হবে না,
কারন তুমি বড় একটা ‘না’ পেয়ে গেছ।
তুমি সবাইকে ঢুকিয়ে নেবে তোমার ছাতার তলায়
এত বড় তুমি।
এই অদ্ভুত বিচক্ষনক্ষমতা দেখলে নিজের
ভালবাসার এই আশ্চর্য বেলুন দেখলে,
যা ভাসতে ভাসতে যাবে আর সব, সব ধরে পুরে নেবে নিজের মধ্যে
কিছুতেই অকুলান হবে না
ঠিক যেন সেই দস্তানা।

৩.

বেঁচে থাকার এই পর্ব খুব উদ্ভট মনে হচ্ছে তোমার।
বছরগুলো, মাসগুলো একটার সঙ্গে একটা জড়িয়ে জাপটিয়ে আছে।
অথচ প্রতিটার থেকে প্রতিটা অন্যরকম,
এক একটার থেকে আর একটার দীর্ঘ দীর্ঘ দূরত্ব।
ভাল আর খারাপ কেমন মিলেমিশে যাচ্ছে, অথচ সকালে কারুর ওপর রাগ হচ্ছে না।
কী আশ্চর্য।
কর্মক্ষমতার ভেতর দিয়ে তুমি সাইক্লোন ম্যানেজ কর,তুমি রাগ ম্যানেজ কর,
ডিনার খেতে আসা বন্ধুগুলোকে চিকেন আর চাটনি বিলাও।
তারপর বাসনও মাজো, হালকা মেজাজে, কেননা কাজকে তুমি ভাঁজে ভাঁজে বেঁটে দিয়েছ
ভাগ করে দিয়েছ সময়ের ফাঁকফোকরে।
তোমার ভেতরে ঠাঁই নিচ্ছে ডাক্তারখানা, টিউটর, তোমার ভেতরে অনায়াসে থাকছে
বিষন্ন বৃদ্ধ আর রাগি প্রৌঢ়ারা।

এত বড়, এত ফাঁকাফাঁকা জীবন, যেন মাইক্রোস্কোপে দেখা কোষকলা।

এত ঘেঁষাঘেঁষি, এত ঠাশবুনোট জীবন, যেন মহাকাশযান থেকে দেখা পৃথিবী।

ঈশ্বর

বার বার ফিরে এসে তোমাদের ঘরে
দেখেছি কেমন দীন, হাভাতে ঈশ্বর
একা একা টিভি দেখে, একা একা রেডিও চালিয়ে
বসে থাকে, গলায় কম্ফর্টার, চোখে ছানি, আর
আঁকাবাঁকা শীর্ণ আঙুলের ভাঁজে কত না কাহিনী।
  
একটি মধ্যবয়সী কবিতা

আসলে মধ্যবয়স সত্য আসলে হরিনাম সত্য
আসলে সত্য মাধবরঙ্গ
আসলে সত্য জীবনে কিচ্ছুটি না থাকা
আসলে জীবনের সবচেয়ে মধ্যখানটায় ফোঁপরা হয়ে যাওয়া সত্য...
আসলে সত্য তোমার ও আমার সমস্ত ভার
আমাদের সমস্ত জটিল কুটিল অস্থির সময়
আসলে সত্য আমাদের সব রকমের হুঙ্কার ও ইগোট্রিপ।

আসলে গাড়ি সত্য গাড়ি তে চেপে ফুটানি সত্য
আসলে পাড়ি সত্য বাড়ির ভেতর এসি সত্য
আসলে সত্য বাথরুমের ফিটিংস

ফিটিংসের কাঁধে মাথা রেখে তোমার কাঁদাটি সত্য না
পাড়ি দিতে দিতে বাড়ির কথা ভেবে তোমার চাওয়াটি সত্য না
বিছানা ও বালিশের মোহে তোমাকে ভাবাটি সত্য না।

আসলে মধ্যবয়স সত্য তবু কৈশোর যা আমাদের কল্পনায়
আসলে মধ্যবয়স সত্য তবু প্রেম যা আমাদের কল্পনায়
আসলে মধ্যবয়স সত্য ক্ষমতার কলকাকলি সত্য
আসলে আয়ুর শেষভাগ সত্য যৌবনের শেষ পাদ সত্য
আসলে ফুরফুর হাওয়া প্রবল গ্রীষ্মের পর সত্য...

আমার তোমার দিকে ঘুরে তাকানো তোমার আমার দিকে ঘুরে তাকান আদৌ সত্য না...
কল্পনার হাতে নিজেদের তুলিয়া দেওয়া অপর্যাপ্ত মিথ্যার হাতে
নিজেদের ছাড়িয়া দেওয়া সত্য না সত্য না সত্য না...
  
নীরবতা, কথা

মাথার মধ্যে চিড়িক মারে বিদ্যুতের মত
একদিন সকালবেলা উঠে বসি ঘামতে ঘামতে
কথা বলা হয়নি কতদিন।

বিপুল নীরবতার আড়ালে ঢেকে রয়েছে তোমার কথা
নীরবতার বালিশ চাপা পড়ে আছে তোমার সমস্ত সত্ত্বা
এত কথা, এত নীরবতা, সব যে কেন।
কেন কেন কেন।

মাথার মধ্যে ফুটতে থাকে ক্রমাগত
আলপিনের মত কথার ছোট ছোট কাচের টুকরোগুলো
শব্দরা, যাদের মানে আছে বা ছিল, একদা...

এও দেখার ছিল তবে? আমরা তো দেখিনি আগে
এভাবে তোলাপাড়া হয়ে যাওয়া, পুরনো তোষকের মত
দামাদ্দাম পিটুনি খেয়ে ধুলো উড়িয়ে আলুথালু হয়ে যাওয়া

এই হেস্তনেস্ত আগে দেখিনি বলেই
ভয় করে, বেদম মিষ্টি আর বিপজ্জনক
হাওয়া দিচ্ছে জানালায়...
নীরবতার ভেতর কথা, আর কথার ভেতর নীরবতা।
এবার নীরবতা ভেঙে ফেলব, টুকরো টুকরো ছড়ানো নীরবতার
উপর দিয়ে হেঁটে যাবে একটা ছোট্টমত ভালবাসার আলুথালু হাঁটা।
তাঁর পায়ে শব্দ ফুটে যাবে, না কি নীরবতার গুঁড়ো...
রক্ত মাখামাখি বালক পায়ের কথা ভাবলে ভয় করে...

যে যে লেখা লেখা হয়নি

যে যে লেখা লেখা হয়নি, তুলনারহিত সর্বনাশ
যে যে লেখা লেখা লিখব বলে ছিল মুলতুবি স্বর্গবাস
যে যে লেখা লেখা লেখিতব্য আমার জন্মের পরিসরে
হাঃ সেই খিল্লিমারা পরিসর, একটু একটু করে
আমাদের গিলে খাচ্ছে, কোথায় আমিই খাব তাকে!
এভাবেই বিল্লিগুলি ইঁদুরের খাদ্য হবে, ফাঁকে-
তালে থাকবে গৃধিনীরা, , খুঁটে খাবে সর্ব অবশেষ
যেভাবে মসৃণ করে কেটে রাখছে ব্লেডেরা তলপেট...
উহঃ এটি খুঁতযুক্ত, ছন্দখানি হল না, প্রবোধ
চন্দ্র থাকলে শোনাতেন। আমরা তবু নিতান্ত অবোধ
লিখে চলছি দিল্লি রোড লিখে চলছি বম্বে রোড কথা
পড়ে চলছি মারাত্মক অন্ধকারে লোডশেডিং গাথা...

জীবনের কনফিউজড কথা বলি ছলাচ্ছল ছলে
বলি প্রেম করা-ইচ্ছে গেছে যেটি শেষ অবধি জলে
নামব ভেবে তরঙ্গে হাঃ! তবু বসে তড়াগের পাড়ে
ব্যথা হয়ে গিয়েছিল মস্তকে ও পিঠে আর ঘাড়ে
রতিউপপাদ্যখানি ওয়ার্ক-আউট করেনি বিছানায়
সুতরাং লিখে ফেলব ভেবেছি নিশ্চিত কল্পনায়
অলৌকিক প্রেমকাব্য, অথবা খুঁতেল কিছু ভাব
অথবা মিশ্রিত ছন্দ। অতুলন, অতীব বিস্বাদ
এইসব দিনরাত্রি ছেঁচে আমি বের করি রস
অম্ল সেই রসধারা এখন বেরিয়ে পড়ছে কষ-
আমার সে অভিজ্ঞতা আর কারু অভিজ্ঞতা নয়?
কী বলছেন, হে হুজুর, আমি জানি একদম নিশ্চয়
সেই স্বাদ অপলক সেই কলস্বাদ জিভময়
আমাদের কে দিয়েছে? একজনই তো, সেই তো সময়!
সময় একখানি চিজ, একজন বিভীষিকালোক
সময় পারঙ্গম, যতখুশি ন্যাকাবোকা হোক
সময় যা পারে তার কণামাত্র পারে না তো কেউ
সময়ের পিঠে চেপে আমরা দিব্য পার হই ঢেউ
জীবনের, জীবনের আদি অন্তে অশ্ব তো সে কাল
অংকুরে বিনষ্ট বীজ, তাকে নিয়ে তিল থেকে তাল
যে সেই মিথ্যের কেন্দ্রে বসে বসে কুমন্ত্রণা করে
যে বোঝায় জীবগণকে এই লোভ অন্ধতা গহ্বরে
একপ্রস্থ নাববার, ভাবা একটি গোল ও সুন্দর
ভাবা এটি মাতৃস্তন সম এক বর্তুল তুন্ডর
অভ্যন্তর, ঘুরে ঘুরে নেবে পড়তে ভাল লাগবে এতে
ভেবে ঝাঁপ, অন্ধ ঝাঁপ, দেবে জীব, যেন সর্ষেক্ষেতে
নেবেছে পক্ষীটি, জাল পাতা আছে ধরে ফেলিবার
চোখে সর্ষেফুল দেখবে কিছু পরে, যখন ফেরার
সময় পাবে না আর, অথবা যেভাবে সেলসম্যানে
গছায় বস্তুটি, চক্র, বিশ্বাস আসে বোকাটে আখ্যানে
ক্রেতার, সে ফালতু কেনে, ভাবে এটা ভাল কাজ করে
টাকা খসানোর জন্য এক্সট্রা আর ফ্রি-এর চক্করে
শেষ অবধি হতবাক, দেখে, আরে এ কী গেরো বাবা!
একি গছাইলেন প্রভু, ফিরিওয়ালা, বনেছি কি হাবা...
ওয়ারিন্টিবিহীন, একবার কিনলে সারা জন্ম সাথ ঃ
রিনিউ হবে না, বক্রপথে ঘুরবে, নো রিটার্ণ পাথ
ফেরত হবে না পয়সা, ফেরানো যাবে না চাকাটিকে
যত বলবে ফিরে এস, তত কন্ঠে চেপে বসবে ফিতে
যে লেখা লিখি নি আজো সেই লেখা কন্ঠে চেপে ধরে
কলমের মাথা থেকে রক্তবৎ শব্দ ঝরে পড়ে
ঘুরতে থাকি চক্রাকারে জীবনের বাটি আকৃতির
গোল গহ্ববরের মধ্যে, সারা জন্ম যে যে প্রকৃতির
ছিদ্র গুনি, সেই ছিদ্রে মাথা দিয়ে পড়েছি ধপাস
মাথায় লেগেছে ভান্ড, কষ বেয়ে পড়ে সর্বনাশ
যেন বিড়ালের মাথা আটকেছে মাটির ভাঁড়েতে
উন্মাদ নৃত্য করি, পা দাপাই, পাড়িনা এড়াতে...
এই তান্ডবেরই কথা লিখি লিখি করেও লিখিনি
আজো আমি কী ভাবে যে লিখতে হয় একটুও শিখিনি...

সে সচ্ছ্বন্দ রাত্রিমূলে এ পর্যন্ত ফলে আর ফুলে
যা ফলেছে সেটুকুই নেব




  একটি কু-লেখা
আলোচনা করলেন অমিতাভ গুপ্ত  

       অচেনা, অথবা চিনলেও বলা যাবে না কেননা অনুমান করাটাই 'রেহেল' পত্রিকার উদ্ভাবনায় বর্তমানে অপ্রাসঙ্গিক তাই কবিপরিচয় অনুমেয়ও হতে পারে না, যে প্রতিভায় দীপ্ত দশটি কবিতা সম্পাদক পাঠিয়েছিলেন নিম্নস্বাক্ষরকারীকে ঢের আগেই, সে সম্পর্কে প্রীতিনিবেদন লিপিবদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু পুনর্লিখনের প্রয়োজন হল। লিপিপ্রয়াসটি 'রেহেল' দপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়ার পূর্ব মূহুর্তে জানা গেল, বলা সঙ্গত আগেই হয়ত জানা ছিল কিন্তু খেয়াল ছিল না, 'রেহেল' একটি ই-পত্রিকা। এই সচেতনতা থেকেই সর্বনাশের শুরু। এখন পর্যন্ত আমি কোনও ই-ম্যাগাজিন দেখিনি। কম্পিউটারের ব্যবহার জানিনা বললে নিতান্ত বিনয় করা হবে। আসলে আমি কোনও দিন কম্পিউটার ছুঁয়েও দেখিনি। মোবাইল ফোন নেই আমার ক্রেডিট কার্ড আর ওই যে এটিএম কার্ড তাও নেই। ফেসবুক সম্পর্কে অজস্র আনজান কথা শুনি, শুনেছি আমাকে নিয়েও নাকি রচিত হয়েছে একটি দুটি, কিন্তু চোখে দেখিনি কখনো। আতঙ্কে, উদ্বেগে দিন কাটাই, রাত কাটে ভয়ে সন্ত্রাসে। ভাবি, এই বুঝি রাজকীয় আদেশ জারি হল কম্পিউটার না-জানলে খাওয়া-পরা সব বন্ধ।
কবিতা লেখাও বন্ধ হয়ে যাবে কি? বন্ধ হয়ে যাবে কবিতা নিয়ে আলোচনা? কম্পিউটার বিরোধী মিছিলে মিছিলে একদা যাদের সঙ্গে হেঁটেছিলাম আজ তাঁরা প্রায় সকলেই কম্পিউটার চাতুর্যে ঝকঝকে। একদা শোনানো হয়েছিল আই টি সেক্টর বিশাল ভারতীয় ভূখন্ডের সমস্ত বেকারত্বকে ঢেকে দেবে। আজ, তরুণ প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে কবিতার পাঠে পাঠান্তর ঘটে যায় -

"এই হেমন্তের আগে দেখিনি বলেই
ভয় করে, বেদম মিষ্টি আর বিপজ্জনক"
এই কবির সব "নীরবতা,কথা" প্রসঙ্গে তাহলে মিষ্টত্বের আর বিপদের অনুষঙ্গেরও কোনো প্রয়োজন নেই।

       দশটি কবিতার প্রতিটিই সুলিখিত বললে অন্যায় হবে। ন্যায়সঙ্গত কথাটি হল প্রতিটি কবিতার প্রতিটি পংক্তিই সাবলীল অর্থাৎ সম্প্রসারণশীল। কবিতার পাঠক জানেন, কাব্যভাষার মধ্যে প্রচুর থাকে থাকে এই সম্প্রসারণশীলতা। অর্থাৎ

"এত বড় এত ফাঁকাফাঁকা জীবন যেন মাইক্রোস্কোপে দেখা কোষকলা।

এত ঘেঁষাঘেঁষি, এত ঠাসবুনোট জীবন, যেন মহাকাশ থেকে দেখা পৃথিবী।"     (বয়স ৩১)

       এ ধরনের কাব্যভাষাব্যবহার পাঠকচিত্তকে অনায়াসে অনায়াসে বহুবাচনিকতায় মোহাবিষ্ট করে। একালের লিপির অতিরিক্ত সুবিধে, যতিচিহ্নের প্রয়োগ প্রয়োজনানুসারে নির্ধারিত করে দেওয়া। এই দশটি কবিতার কোনো কোনোটি আবার পূর্ণচ্ছেদহীনভাবে শেষ হয়েছে, লীডারচিহ্ন ব্যবহারের প্রবণতাও প্রখর, অবশ্য পূর্ণচ্ছেদচিহ্নটির সামগ্রিক ব্যবহারও কবি করেছেন। সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে বাকসুন্দ ও লিপিসুন্দ উভয়ক্ষেত্রেই প্রখর সতর্কতা বজায় রেখে কবি বাংলাকাব্যভাষাকে প্রসারিত করার উদ্যোগে সতীর্থ হয়েছেন। প্রার্থনা রইল তাঁর তীর্থপথ বিভাসিত হয়ে উঠুক আরো বহুদিন বহুবছর, যখন কম্পিউটার থাকবে না সেই শতাব্দী পর্যন্ত।

       এই দশটি কবিতার মধ্যে কোনো কোনো পাঠকের কাছে হয়ত চতুর্থ কবিতাকেই ('দামিনীকে') কবিতাগুচ্ছের নান্দনিক বর্ণ নির্ণায়ক ব'লে মনে হতে পারে। এমন মনে হওয়াটা ভুল নয়, আবার অভ্রান্তও নয়। অভ্রান্ত নয় কেননা - 'দামিনী' বললেই যদি 'চতুরঙ্গ' মনে পড়ে। যদি মনে হয় 'দামিনী'র রূপকাভাসটিকে পেরিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল কি অযথা। আবার ভাবনাটি ভুলও নয়। ছন্দবৈদাগ্ধ্য কবি 'দামিনীকে' যা  জানিয়েছেন তা পাঠকের সর্বার্থ জ্ঞেয়, ইচ্ছে করে যেন চ্যুত করা হল একটি অর্ধমাত্রাকে - 'নীরবতা নয় দু'মিনিট'

       ভাবি, কি ক্ষতি হত এই কবিতাগুচ্ছ ফল্গু বসুর বা অশোক ঘোষের পত্রিকায় ছাপা হলে। বহরমপুরের সদ্যলুপ্ত 'আকাশ' পত্রিকায় ছাপা হ'লে? ফল্গুও বেঁচে নেই। তাঁর পত্রিকা ছাপা হত লাইনোয়। তারপর ডিটিপি এল। অলোক পুরুলিয়া থেকে একক পরিশ্রমে নিয়মিত ডিটিপি ক'রে পত্রিকা প্রকাশ করেন, বিনামূল্যে তিনশ' কপি বিতরণ করেন। ডাকব্যয়ও তাঁরই। দরিদ্র, তুচ্ছ চাকরিটি থেকেও অবসর নেওয়া অশোকের পত্রিকাটিই তাঁর বিল্বসংসার।

       ই-ম্যাগাজিনের মাধ্যমে এই দশটি কবিতা লক্ষ্যাধিক নাকি সহস্রাধিক পাঠকের কাছে পৌঁছাবে। ভালো, ভালোই তো। কলকাতার একজন ট্যাক্সিচালককে একদা স্বগতোক্তি করতে শুনেছিলাম। 'রাজীব গান্ধী স্বয়ং ভগবান। উনিই তো আমাদের ইন্টারনেট এনে দিয়েছেন।' মার্কসসাহেবের ফাস্কোক্নিচালক আরবান প্রলেটারিয়েট। ভারতবর্ষের রাষ্ট্রনায়কের কাছে 'উই নিড টু বি পোস্টমডার্ণ ইন আওয়ার অ্যাপ্রোচ টু কম্পিউটার'একজন কবিতা পাঠকের কাছে প্রার্থিত শুধু এই দশটি কবিতা, এবং এই দশটি কবিতার মতো আরো অজস্র নক্ষত্রচ্যুতিতে ঝলমল করে ওঠা মননবিল্ব।

       প্রথম কবিতাটি,  তাই, যদি 'দোকানের কবিতা' হয় তৃতীয়টিকে যেন অনিবারণীয় হয়ে উঠতে হয় 'ড্যাঞ্চিবাবুদের গল্প'এর মধ্যেই প্রস্তুত হয়ে হয় 'জিন্দা লাশ' দামিনীকে, পুনর্বিতরণের জন্য। এবং ' আকাশভরা চাঁদ অবশ্য যায় না কেনা' এই অন্তর্ঘাতটিকে 'তুলনারহিত সর্বনাশ'-এর দিকে ভাসিয়ে দিলেই বুঝি এই কবিতাগুচ্ছের সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্দিষ্টকে নিয়ে যেতে পারি। পাঠক, পাঠ করুন 'যে লেখা লেখা হয়নি' কবিতাটি। পাঠ করে নির্বাক হয়ে উঠুন। আপনার এবং আমার ও আমাদের আপাতত সব কথাই এ কবিতার শ্লোকসংযোগী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন